
২৬ জুলাই যখন মানিকগঞ্জের আটিগ্রাম ইউনিয়নের বাসাই এলাকায় পৌঁছাই তখন বিকেল। গ্রামের বেহাল কাঁচা রাস্তা মাড়িয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ল এক টুকরো জমিতে পাশাপাশি দুটি টিনের ঘর। ঘরের সামনে সামান্য খালি জায়গা। আরও একটু সামনে একচিলতে পুকুর। তারপর খোলা মাঠ। স্কুলের নাম ব্লুমস (বিকনিং লাইট অর্গানাইজেশন অব ম্যানকাইন্ড অ্যান্ড সোসাইটি)। কচি-কাঁচা শিক্ষার্থীরা সবাই বসেছে মাদুর বিছিয়ে। তাদের পড়াচ্ছিলেন দুজন শিক্ষক। স্কুলের এক শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাইলাম, আজ তোমাদের কী পড়ানো হলো? ছেলেটি উত্তর না দিয়ে আমার দিকে শুধু তাকিয়ে রইল। আবার জিজ্ঞেস করব কি না ভাবছি। এর মধ্যেই শিক্ষক শামীমা নাসরীন জানালেন, ‘ভাই, আলমগীর তো কানে শোনে না, কথাও বলতে পারে না। আরেকজনকে জিজ্ঞেস করেন।’ শুধু আলমগীর একা নয় মাহিদুল, সবুজসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীর একই সমস্যা। তারা শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তবে পড়াশোনায় নাকি অন্যদের চেয়ে ভালো। ব্লুমস নামের এই স্কুলটি একটি বিশেষায়িত স্কুল। প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের এই বিদ্যালয়টি আমাদের কাছে আরও বেশি অর্থবহ হয়ে উঠবে যখন আমরা জানব এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর একজন সাহসী কর্মকর্তা। যিনি প্রাণ দিয়েছিলেন ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায়। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এই সহকারী কমিশনারের নাম রবিউল করিম।
বাবার স্বপ্ন, ছেলের পূরণ
কথা হচ্ছিল বিদ্যালয়ের আঙিনাতে বসেই। আমাদের এই স্কুলের শুরুর গল্প শোনাচ্ছিলেন রবিউল করিমের ছোট ভাই শামসুজ্জামান। ‘বাবা (আবদুল মালেক) প্রায়ই মা-ভাইয়ার সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করতেন। বাবার খুব ইচ্ছা ছিল এমন একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু বাবা সেটা করে যেতে পারেননি।’ বাবার স্বপ্নপূরণের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন রবিউল। কিন্তু স্কুল তৈরি করা তো সহজ কথা নয়। সবার আগে দরকার জমি? জমি মিলবে কোথায়? এগিয়ে এলেন মা করিমুন্নেসা। ‘স্কুলের এই ২৯ শতাংশ জমি আমার মায়ের। ভাইয়ার উৎসাহ দেখে তিনি এটা দান করে দিয়েছেন স্কুলের জন্য।’ বলছিলেন শামস। এরপর চলল শিক্ষার্থীর খোঁজ। আটিগ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় কোন বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোররা আছে। ব্লুমসের অন্যতম সংগঠক আবদুল আওয়াল বলছিলেন, ‘আমরা জরিপ করে প্রথমে মোট ১৫৮ জন বাচ্চার খোঁজ পাই। তারপরই বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের স্কুল সম্পর্কে বলা হয়। প্রথমে তেমন সাড়া মেলেনি। কামরুল ভাই (রবিউল করিম) নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন। নিজস্ব গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন।’
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ২২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশেষায়িত এই বিদ্যালয়ের। ছুটিতে কাটিগ্রামের বাড়িতে এলে রবিউল করিমের বেশি সময় কাটত এই বিদ্যালয়ে। মজা করে পড়াতেন বাচ্চাদের। স্কুলের পড়ুয়ারা তাঁকে চিনত ‘বড় স্যার’ নামে। শিক্ষক, স্কুলের সংগঠকদের সঙ্গে বৈঠক হতো বিদ্যালয়ের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে। তহবিল সংগ্রহ, নিয়মিত খরচ বহন করার জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করার মতো নানা বিষয় নিয়ে কাজ করতেন।
কাউসার ও তার বন্ধুরা
স্কুলে ঢোকার সময় থেকেই ছেলেটিকে খেয়াল করছিলাম। ঠিকভাবে মাথা তুলতে পারে না। পা অচল বলে হাঁটছিল ক্রাচে ভর করে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার নাম কী?’ একটু সময় নিয়ে কিছু একটা যেন ভাবল কাউসার। তারপর শুধু উচ্চারণ করল ‘হু’। বুঝতে পারলাম সে আমার কথা শোনেনি। আবার জিজ্ঞেস করলাম একটু জোরে। এবার সে বুঝল। বলল, ‘আমি কাউসার।’ স্কুলে আসতে ভালো লাগে? লাগে। খুব ভালো লাগে।
কাউসারের মতো এই বিদ্যালয়ের ৩২ জন শিক্ষার্থীর কোনো না কোনো শারীরিক কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে। কিন্তু রবিউল করিমের গড়া এই স্কুলের পুরো সময়টুকু তারা বেশ আনন্দে কাটায়। সেটা বোঝা যাবে ওদের নানা রকম কাণ্ডকীর্তি দেখে। যারা হাঁটতে পারে না তাদের দেখা গেল ক্যারম খেলছে জমিয়ে। কেউবা আবার মেতেছে আঁকিবুঁকিতে। আবার রমজান আলীর মতো ডানপিটে দলের যারা, তারা দৌড়ায় ফুটবল নিয়ে। তাই অভিভাবকেরাও এখন অনেক আগ্রহী এই স্কুল নিয়ে। বিদ্যালয়ের ভ্যান বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের আনা-নেওয়া করে। অনেকে আবার সন্তানসহ নিজেই হাজির হন বিদ্যালয়ে। তেমনি একজন ভগবানপুর গ্রামের মনীষা রানী সরকার। তাঁর নয় বছরের মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে নিয়মিত আসেন স্কুলে। ‘আমার মেয়েটা হাঁটাও পারে না, বসাও পারে না, এই জন্য সঙ্গে আনি। স্কুলে এলে পরে ও খুশি হয়।’ বলছিলেন মনীষা রানী।
ব্লুমসের প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম। যিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা থেকে জড়িত। তিনি জানালেন, সপ্তাহে চার দিন খোলা থাকে স্কুল। বর্ণমালা পরিচিতি, গণনা, ছড়া পড়ানো ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার থাকে খেলাধুলার আয়োজন। এ ছাড়া প্রতিবছর মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করা হয়।
প্রতি মাসে বিদ্যালয় পরিচালনার ন্যূনতম অর্থ ব্যক্তিগতভাবে নানা উদ্যোগ নিয়ে সংগ্রহ করা হতো। এ ছাড়া লায়ন্স ক্লাব প্রতি মাসে স্কুলের জন্য পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেয়। জাহাঙ্গীর আলম শেষে যোগ করলেন, ‘এত দিন স্কুল পরিচালনা নিয়ে আমাদের তেমন চিন্তা ছিল না। কামরুলই (রবিউল করিম) সব ব্যবস্থা করত। এখন ভাবতে হচ্ছে।’
কথা হয় রবিউল করিমের স্ত্রী উম্মে সালমার সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘ওর স্বপ্ন ছিল স্কুল বড় করা, বিনা খরচে চিকিৎসা দিতে পাশে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। জানি না এখন আমরা কতটুকু করতে পারব।’ রবিউল করিমের মা করিমুন্নেসা প্রায় নির্বাক। ছেলের কথা বলতে গিয়ে চোখ জলে টলমল। অনেক কষ্টে শুধু বললেন, ‘সবাই এগিয়ে এলে আমার ছেলের স্বপ্ন পূরণ হবে।’
আলাপ শেষে আমরা চলে আসব। ছবি তোলার জন্য স্কুলের সব বাচ্চারা একসঙ্গে দাঁড়াল। ওদের মুখে হাসি। ওরা হয়তো বুঝে উঠতে পারেনি ওদের ‘বড় স্যার’ আর তাঁর প্রিয় স্কুলে আসবেন না কোনো দিন। রবিউল করিম নামের সেই ‘বড় স্যার’ ওদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। ওদের সেই হাসি নিশ্চয়ই আমরা মুছে যেতে দেব না।
রবিউলের প্রথম উদ্যোগ নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে একসময় গ্রামে থিতু হন রবিউল করিম। চিন্তা ছিল, চাকরি না করে কৃষি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়া। সেই প্রকল্প পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। ‘গ্রাম বদলের’ স্বপ্ন থেকেই তাঁরা প্রতিষ্ঠা করেন নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি নামের কিন্ডারগার্টেন স্কুল। ‘সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আমরা ২০০৭ সালে স্কুলের কার্যক্রম শুরু করি।’ বলেন নজরুল বিদ্যাসিঁড়ি স্কুলের পরিচালক ও রবিউল করিমের বন্ধু মিজানুর রহমান। তিনি জানান, স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় ছাত্রছাত্রী পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। তবে ভালো ফলাফল করতে থাকলে অনেক অভিভাবক তাঁদের সন্তানকে এনে স্কুলে ভর্তি করান। কিছুদিনের জন্য ইতালি গিয়েছিলেন রবিউল করিম। সে সময় সব প্রকল্প থমকে গেলেও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন মিজানুর রহমান। শুরুর কয়েক বছর স্কুলে প্লে গ্রুপ থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী পড়ানো হতো। এখন পরিসর বেড়েছে, ২০১২ সাল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাচ্ছে কাটিগ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী। মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল স্কুলটা অনেক বড় করার। কামরুল (রবিউল করিম) চলে যাওয়ার পর আর মনে জোর পাই না। জানি না কত দূর পারব।’