প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষিত রাজনৈতিক প্রভাবে দখল ২৮৪ খাল

0
2312

ঢাকা অফিস: বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নৌ-প্রটোকলভুক্ত বাগেরহাটের মংলা-ঘসিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌপথ চ্যানেলে সংযুক্ত ২৮৪টি খাল দখল করে চিংড়ি চাষ করছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। রাজনৈতিক প্রভাববলয়ে থাকা এসব চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের নেতাÑ কেউই পিছিয়ে নেই খাল দখল উৎসবে। লবণ পানির এসব খালে বাঁধ দিয়ে চলছে চিংড়ি চাষ। এই অবৈধ কর্মকা- থেকে আসা অর্থের একটি বড় অংশ যাচ্ছে রাঘববোয়ালদের পকেটে। বারবার খালগুলো দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা, নেপথ্যে থাকছে রাঘববোয়ালদের সমর্থন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর খাল দখলমুক্ত করার নির্দেশও কানে তোলেনি তারা। আমাদের সময়ের সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যত্রতত্র বাঁধের কারণে চরম নাব্যতা সংকটে পড়তে যাচ্ছে মংলা-ঘসিয়াখালী নৌরুট। তারা বলেন, খালগুলো দখলমুক্ত করে জোয়ার-ভাটার স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে চরম সংকটে পড়বে আন্তর্জাতিক এই নৌরুট। এদিকে দখলদারদের উচ্ছেদ ও খালের অবৈধ বাঁধ অপসারণ না হওয়ার জন্য প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মীরা। তারা বলেন, এই কার্যক্রমে নৌবাহিনী যুক্ত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায় প্রায় ৩০০টির মতো সরকারি রেকর্ডভুক্ত খাল আছে। এর মধ্যে ১৫-১৬টি ছাড়া বাকিগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। দখলে থাকা খালগুলোয় প্রায় দেড় হাজারের বেশি বাঁধ নির্মাণ করে চলছে চিংড়ি চাষ। তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, রামপাল উপজেলায় খাল ও শাখা খালসহ প্রায় ৩৫০টির মতো খাল আছে। এসব খালের পাশ দিয়ে রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। ওইসব জমির মালিকরাই মূলত নিজেদের জমির সঙ্গে খালের জায়গা যুক্ত করে চিংড়ি চাষ করছেন। জানা গেছে, মংলা-ঘসিয়াখালী চ্যানেলে এখন জোয়ারের সময় ২০-২২ ফুট এবং ভাটার সময় ১০-১২ ফুট গভীরতা থাকে। ড্রেজিং করার পরও এ গভীরতা দিন-দিন কমেই চলেছে। রামপালে ১০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) আছে। এই প্রতিটি ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেই সরকারি খাল দখলের অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সর্বপ্রথম ২০১০ সালে বিআইডব্লিউটিএ ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারি খাল দখলমুক্ত করার কাজ শুরু করে। কিছুদিন পর সে কার্যক্রম পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ছয় মাস পর ফের খাল কাটা কার্যক্রম শুরু হলেও তা বেশিদূর এগোয়নি। পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোটে’র আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শাহনেওয়াজ আলী আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের কথা আর কাজে কোনো মিল পাচ্ছি না। আমরা বলছি না সরকারের আন্তরিকতার অভাব আছে। কিন্তু যা বলছে তা করছে না। সরকারের ভেতরে থাকা কিছু অসাধু ব্যক্তির কারণে বেদখল এসব খাল উদ্ধার করা যাচ্ছে না। একটা সময় এটা বুমেরাং হতে পারে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রামপাল উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোয়াজ্জেম হোসেনের দখলে রয়েছে উড়াবুনিয়া খালের একাংশ। বিশাল এ খালটির অন্য অংশ দখল করে আছেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি শেখ নাসিরউদ্দিন। পেড়িখালী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাবুল কাটাখালী এবং মহেশের খালের ১০০ বিঘার মতো সরকারি জমি দখল করে চিংড়ি ঘের করেছেন। বাইনতলা ইউপি চেয়ারম্যান ফকির আব্দুল্লাহ বুধারডাঙ্গা খালের ২০-২৫ বিঘা অংশ দখলে নিয়েছেন। ভোজপাতিয়া ইউপির চেয়ারম্যান নুরুল আমিনের দখলে আছে পাঁচ-ছয়টি খাল। এর মধ্যে লেবুতলার খাল, খাসিয়ার খাল, বাঁশবাড়িয়ার খাল ও বরইতলার খাল উল্লেখযোগ্য। ১ নম্বর গৌরমবাহ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সরকার সেলিমের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুটিমারী নদীর প্রায় ১০০ বিঘা জমি। রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ আব্দুল ওয়াহাবের দখলে আছে পুটিমারী নদীর বাঁশখালির অংশের ১৫-২০ বিঘার মতো জমি। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর ইউপির চেয়ারম্যান জামিল হাসান জামিলের দখলে আছে পুটিমারী নদীর প্রায় ১০০ বিঘার মতো জায়গা। রামপাল উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মাদ আবু সাইদ বাঁশতলীর খালের ৩০ বিঘা জায়গা দখলে নিয়ে চিংড়ি চাষ করছেন। বাঁশখালি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মাদ আলীর দখলে আছে বাঁশখালি খালের ৮-১০ বিঘা। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পেড়িখালির চেয়ারম্যান বাবুল খাল দখল চালিয়ে যেতে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। এলাকায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করে তার লোকজন। আতঙ্ক ছড়াতে মাঝেমধ্যে ফাঁকা গুলিও ছোড়ে তারা। তাদের ভয়ে স্থানীয়রা টুঁ-শব্দটিও করতে পারেন না। বাবুল চেয়ারম্যানের দখলে থাকা খালগুলো ড্রেজিং করে অনুমতি ছাড়াই অন্যের ঘের ভরাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি মাছের ঘেরে জোর করে বালুও ফেলেছে তার লোকজন। সরেজমিন পেড়িখালি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যত্রতত্র বালু দিয়ে ভরাট করার কারণে মরে যাচ্ছে গাছপালা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই ইউনিয়নের এক বাসিন্দা আমাদের সময়কে বলেন, তার (বাবুল) আচরণ দেখলে মনে হয় সবকিছু তার কথাতেই চলে এবং চলবে। আমার ঘেরে ৫ লাখ টাকার মাছ ছিল। কিন্তু কোনো কথা না শুনে বাবুল চেয়ারম্যান ও তার লোকজন বালু দিয়ে ঘেরটি ভরাট করে ফেলেছে। এখন আমি পথে বসে গেছি। শুধু তাই নয়, মংলা উপজেলার একটি সরকারি খাল দখলের সঙ্গে একজন সাবেক সংসদ সদ্যস্যের নামও জড়িয়ে পড়েছে। মংলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হাওলাদার আবু তাহেরের দখলে রয়েছে আমলাতলার একটি খাল। তবে এই খালের লিখিত চুক্তিপত্র রয়েছে স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্যের নামে। খালটি মংলার আমলাতলা এলাকায় অবস্থিত। এদিকে রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ আব্দুল ওয়াহাবের বিরুদ্ধে খাল দখলের অভিযোগ করেছেন তার দলেরই এক নেতা। বিষয়টি জানিয়ে বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন ভোজপাতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ অহিদুজ্জামান। গত ১১ জুলাই করা লিখিত অভিযোগে বলা হয়, শেখ আব্দুল ওয়াহাব ভোজপাতিয়া ইউনিয়নের বেতকাটা বাজারের দক্ষিণে তার চিংড়ি খামারের মধ্যে দুই কিলোমিটার সরকারি রেকর্ডভুক্ত খালে দুটি অবৈধ বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষ করছেন। এতে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে আছে। তার কারণে ভোজপাতিয়া ইউনিয়নে সরকারি রেকর্ডভুক্ত সব খালের অবৈধ বাঁধ অপসারণ করতে পারছে না উপজেলা প্রশাসন। শেখ অহিদুজ্জামান আমাদের সময়কে জানান, গত বুধবার এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ জানতে রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তাকে। তবে রামপাল উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ আব্দুল ওয়াহাব আমাদের সময়কে বলেন, আমার নিজের ৩০ একরের ঘের আছে। তবে তা কোনো নদী বা খালের অংশ নয়। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়। এসব ষড়যন্ত্র। এদিকে ভোজপাতিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যেসব দখলের কথা বলা হয়েছে, তা আসলে কারো দখলেই নেই। আমার নির্বাচনি এলাকার বেশিরভাগ বাঁধই কেটে দেওয়া হয়েছে। এই বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরই আগের অস্থান পাল্টে তিনি অভিযোগ করেন, আমার দখলে কোনো খাল নেই। তবে অন্যদের দখলে আছে। এর মধ্যে শেখ অহিদুজ্জামানের দখলে রয়েছে জিওলমারী খাল (দাগ নম্বর ১৭৭১, ১৭৭২)। সাবেক চেয়ারম্যান ও থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক তরফদার মাহফুজুল হক টুকুর দখলে আছে পুটিমারি খাল (দাগ নম্বর ১৬৭২)। এই খাল দখলদাররাই আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসে অপপ্রচার চালাচ্ছে। রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব কুমার রায় আমাদের সময়কে বলেন, এ বছরও এক হাজার ৬০০ বাঁধ কাটা হয়েছে। এর আগে পর্যবেক্ষণের অভাবে সাধারণ মানুষ নিজেদের ব্যক্তিমালিকানায় থাকা জমির মধ্যে খালগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতেন। আপনারা যেসব অভিযোগের কথা বলেছেন তা আগে ছিল। এই মুহূর্তে আর কোনো খাল বেদখল নেই। মংলা-ঘসিয়াখালী চ্যানেলের খাল রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুর রানা আমাদের সময়কে বলেন, কিছু-কিছু বাঁধ অপসারণ করা হলেও এখনো বেশিরভাগ খাল বেদখল আছে। স্থানীয় প্রশাসনের বক্তব্য দিতে হয়, তাই তারা সেটি দেন। বাস্তবের সঙ্গে তাদের বক্তব্যের কোনো মিল নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের চেরাইখোলার সরকারি খালে বাঁধ দিয়ে একই গ্রামের সোহাগ, সাইফুল, আজম, টিক্কাসহ ১০-১২ জন মাছ চাষ করে আসছিলেন। গত ২০ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিব কুমার রায়ের নির্দেশে বাগেরহাটের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইরফান উদ্দিন আহম্মেদ ওই খালের বাঁধ কেটে মংলা-ঘসিয়াখালী চ্যানেলের সঙ্গে সংযোগ করে দেন। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুর্র্বৃত্তরা বাঁশের ফাইলিং দিয়ে ফের খালটি আটকে দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু তালেব শেখকে বাদী হয়ে রামপাল থানায় মামলা করতে বলেন। কিন্তু রামপাল থানার ওসি মো. বেলায়েত হোসেন প্রথমে মামলাটি নিতে চাননি। উল্টো বিবাদীপক্ষকে ডেকে আপস করে পরদিন থানার এসআই সুদেব কুমারকে পাঠিয়ে খালটির একটি বাঁধ অপসারণ করান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বেলায়েত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, মামলাটি নেওয়া হয়েছিল। বাদীপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দেরিতে মামলা নেওয়া হয়। আসামিরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেওয়ায় তাদের গ্রেপ্তার করা যায়নি। মংলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নে সরকারি রেকর্ডভুক্ত বেশ কয়েকটি খাল আছে। এই খালগুলো মংলা-ঘসিয়াখালী চ্যানেলের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। এর মধ্যে তকতামারী, কাটাখালি ও সুরমোহলি নামক বড় তিনটি খালে বাঁধ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ করছেন গোলাম সরোয়ার ওরফে সরো হাজি নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এদিকে প্রায় এক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের অধীনে রামপাল-মংলার সরকারি রেকর্ডভুক্ত খালগুলোর অবৈধ বাঁধ অপসারণে ১ হাজার ৫০০ টন চাল বরাদ্দ দেয় সরকার। এর আগে দুই বছর ধরে খালগুলো দখলমুক্ত করতে সরকারি নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।