শরীয়তপুরে ১০ টাকা কেজি চাল বিক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ!

0
2536
চাউল দূর্নীতির ফাইল ছবি...............................গড়াইনিউজ২৪.কম

আবু রায়হান (বর্ষন), শরীয়তপুর প্রতিনিধি: হতদরিদ্র জনগোষ্ঠির খাদ্যাভাব দূরীকরনের লক্ষ্যে সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসুচির আওতায় মাত্র ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরনে অবিশ্বাস্য রকমের অনিয়ম আর দুর্নীতি শুরু করেছে শরীয়তপুরের ডিলাররা। গোসাইরহাট উপজেলার এক যুবলীগ সভাপতির চাল চুরির দুর্নীতি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে পুরো জেলা জুড়ে। রাজনৈতিক চাপে দূর্নীতিবাজ এমন ডিলারদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোন রকমের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন না করার ফলে অঙ্কুরেই বিনাশ হতে চলেছে প্রধানমন্ত্রীর এই মহৎ উদ্যোগ।
“শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ” এই শে¬াগানকে পূঁজি করে দেশ ব্যাপী শুরু হয়েছে ১০ টাকা কিলোগ্রাম (কেজি) দরে সরকারি চাল বিক্রি। খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেশের ৬৪ জেলায় এক সাথে ৫০ লক্ষ হতদরিদ্র পরিবারকে প্রতি কেজি চালে সাড়ে ২৭ টাকা ভর্তুকি দিয়ে দরিদ্র লোকদের সস্তায় চাল কিনে খাবার এই সুযোগ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার। গত মার্চ মাস থেকে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে দরিদ্র মানুষের তালিকা প্রস্তুত পূর্বক ন্যায্য মূল্যে চাল বিতরনের জন্য ডিলারও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নীতিমালা লংঘন করে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের সুপারিশে শরীয়তপুর জেলার ৬ উপজেলার ৬৫ ইউনিয়নে ১ শত ২৫ জন ডিলার নিয়োগ দেয়া হয়। যাদের বেশীরভাগই আওয়ামলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অন্যান্য অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের নেতা কর্মী।
প্রতি ৫ শত পরিবারের জন্য একজন করে ডিলার নিয়োগ করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তর সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী শরীয়তপুর জেলার ৬৫ ইউনিয়নের ৩৮ হাজার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ৭৬ জন ডিলার নিয়োগ দেয়ার কথা। কিন্তু দলীয় নেতা কর্মীদের পূনর্বাসনের লক্ষ্যে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ১২৫ জন ডিলার।
প্রতি ইউনিয়নে অতি দরিদ্র লোকদের তালিকা প্রস্তুুত করে প্রতি মাসে তাদের ৩০ কেজি করে চাল বিতরনের নিয়ম রয়েছে। ভোক্তাদের নামে রেশন কার্ড ইস্যু করে বিধিমালা অনুযায়ী চাল বিক্রির কথা থাকলেও কর্মসূচি বাস্তবায়নের শুরুতেই শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় ডিলার নামের সরকার দলীয় নেতা কর্মীরা অবিশ্বাস্য রকমের দূর্নীতি আর অনিয়ম শুরু করে দিয়েছে। প্রতি কেজি চালের দাম ৩৬ টাকা নির্ধারণ করে ২৭ টাকা ৫০ পয়সা ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করছে সরকার। ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রতি কেজিতে রাখা হচ্ছে ১০ টাকা। ডিলার সরকারকে প্রতি কেজির বিপরীতে পরিশোধ করছে ৮ টাকা ৫০ পয়সা। ডিলার তার খরচ বাবদ প্রতি কেজিতে রেখে দিচ্ছে ১ টাকা ৫০ পয়সা। ডিলার প্রতিটি চটের বস্তা বিক্রি করে আরো পাচ্ছে ৫০ টাকা। তারপরেও দরিদ্র মানুষদের সাথে প্রতারণা করে চাল বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে কালো বাজারে।
চৈত্র, বৈশাখ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কার্তিক (মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর) এই ৫ মাস দরিদ্র পরিবারগুলোর মধ্যে ১০ টাকা ন্যায্য মূল্যে চাল বিতরণ করা হবে। প্রতিটি পরিবারকে মাসে একবার ৩০ কেজি করে মোট ১ হাজার ১ শত ৪০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হবে জেলার ৬৫ ইউনিয়নের ৩৮ হাজার পরিবারের মধ্যে। গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে চাল বিতরণ (বিক্রি) এর কাজ। সপ্তাহে শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার এই তিন দিন সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত চাল বিক্রির নিয়ম রয়েছে। প্রতিটি বিক্রয় কেন্দ্রে একজন করে তদারকি কর্মকর্তা স্বশরীরে উপস্থিত থেকে চাল বিক্রি তদারকি করার কথা।
অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে, ডিজিটাল মিটারে চাল মেপে দেয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ডিলার চাল মেপে দিচ্ছে বালতি ভরে। ফলে প্রত্যেক ভোক্তা ২ থেকে ৪ কেজি চাল কম নিতে বাধ্য হচ্ছে। কোন বিক্রয় কেন্দ্রেই দেখা যায়নি তদারকি কর্মকর্তাকে। জানা গেছে, ট্যাগ অফিসার ডিলারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে কর্মস্থলে বসে থাকে তারা। অনেক স্থানে প্রকৃত হতদরিদ্রদের বাদ দিয়ে ভোক্তা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে আর্থিক অবস্থা সম্পন্ন স্বচ্ছল ব্যক্তিদের। যাদের পরিবারে একাধিক সদস্য বিদেশে থাকে এবং আয় রোজগারের একাধিক মাধ্যম রয়েছে, এমন শত শত পরিবারের নামে কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। শরীয়তপুর সদর উপজেলার আঙ্গারিয়া ইউনিয়নের দরিচর গ্রামের কালু মাদবরের ছেলে ১২০১ নং কার্ড হোল্ডার সাইদুল মাদবর এবং ১২০২নং কার্ড হোল্ডার একই গ্রামের জাহার আলী মাদবরের ছেলে আনোয়ার হোসেন দীর্ঘ দিন যাবৎ প্রবাসে থাকার পরেও তাদের নাম হতদরিদ্রের তালিকাভূক্ত করে কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। অথচ একই ইউনিয়নের চরযাদবপুর গ্রামের বকুল শিকদারের ছেলে মোসলেম শিকদার একজন হতদরিদ্র দিন মজুর হওয়ার পরেও তার নাম এই তালিকায় উঠেনি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নানাবিধ অনিয়মের মধ্য দিয়েই চলছে এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। উঠে এসেছে ডিলার নামের আওয়ামীলীগ নেতা কর্মীদের অবিশ্বাস্য অনিয়ম ও দূর্নীতি। এ চিত্র জেলার গোসাইরহাট উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে লক্ষ্য করা গেছে অধিক হারে। গোসাইরহাটের আলাওলপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি মাসুদ রানার নামে জালালপুর নতুন বাজারে দেয়া হয়েছে একটি ডিলারশীপ। মাসুদ রানা গত ৯ সেপ্টেম্বর সাড়ে ৪ মেট্রিক টন চাউল উত্তোলন করে গোসাইরহাট খাদ্য গুদাম থেকে। তার অধীনস্ত ৩ শত ভোক্তা থেকে শতাধিক ভোক্তার কার্ডে সেপ্টেম্বর মাসের ১০, ১৬ ও ১৭ তারিখে ৩০ কেজি করে চাউল বিতরন করার তথ্য উল্যে¬খ করে মাষ্টার রোল ও কার্ডে ভোক্তাদের স্বাক্ষর/টিপ সই রাখেন। কিন্তু ওই সকল ভোক্তাদের বাড়ি গিয়ে জানা গেছে তারা এক ছটাক চাউলও উত্তোলন করেননি। এমনকি হাতে গুনা কয়েকজন ভোক্তাকে ৩০ কেজির স্থলে ১৫ কেজি ও ১০ কেজি করে চাল দিয়ে তাদের কার্ডে ৩০ কেজি চাল এন্ট্রি করে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে।
আলাওলপুর ইউনিয়নের উত্তর কোদলপুর রশিদ হাওলাদার কান্দি গ্রামের খালেক বেপারী, লিটন মিয়া, রাশিদা বেগম, সামসুন্নাহার, সুফিয়া বেগমসহ বেশ কয়েকজন হতদরিদ্র কার্ডধারী ভোক্তা বলেন, মাসুদ ডিলার আমাদের কার্ডে সেপ্টেম্বর মাসের ১০, ১৬ ও ১৭ তারিখে ৩০ কেজি করে চাউল দেয়ার কথা লিখে দিয়ে আমাদের হাতের টিপ সই রেখেছে কিন্তু আমরা তার কাছ থেকে কোন চাউল কিনি নাই। একই গ্রামের রাজ্জাক বেপারী বলেন, আমি ৩০ কেজি চাউল কেনার জন্য ৩০০ টাকা নিয়ে গেলে মাসুদ চোকিদার বলেন, আমারে ১৫ কেজি চাউল দিয়া কার্ডে ৩০ কেজি চাউল বসাইয়া দিছে। ওই গ্রামের হাতেম আলী সরদার বলেন, আমার কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়া আমারে মাত্র ১০ কেজি চাউল দিছে। কিন্তু আমার কার্ড হাতে দেয় নাই।
আলাওলপুর লালমিয়া বেপারী কান্দি গ্রামের হতদরিদ্র এনায়েত সরদারের স্ত্রী শাহিনুর বেগম বলেন, আমার স্বামীর নামের কার্ড নিয়া আমি চাউল নিতে আইছি। ডিলার করিম কাজী আমার কাছ থেইকা ৩০০ টেহা (টাকা) নিয়া আমারে ২৭ কেজি চাউল দিছে। এদিকে শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের কোয়ারপুর গ্রামের আলেয়া বেগম বলেন, আমারে ডিলার মোনায়েম খান ৩০ কেজি চাউল না দিয়া ২৬ কেজি চাউল দিছে। চাউল কম দেয়ার কথা জানতে চাইলে তার কর্মচারিরা আমারে বকা ঝকা করে পাঠাইয়া দিছে।
গোসাইরহাট উপজেলা জালালপুর নতুন বাজারের ব্যবসায়ী সোহেল সরদার জানিয়েছেন, ডিলার মাসুদ রানা ওরফে মাসুদ ডাক্তার ওরফে মাসুদ চৌকিদার ঠিক মত দোকান খুলে না। গরীব মানুষের কাছে ১০ টাকা দরে চাউল বিক্রি না করে কালো বাজারে ২৫-২৬ টাকা কেজি দরে বস্তায়ব স্তায়ায় চাউল বিক্রি করে দিচ্ছে। সে যুবলীগের বড় নেতা এবং চেয়ারম্যানের কাছেরলোক বলে কেউ তাকে কিছু বলতে সাহস পায় না।
আলাওলপুর ইউনিয়নের তদারককারী কর্মকর্তা মো. মোক্তার হোসেন বলেন, ডিলার মাসুদ রানার দোকানে গিয়ে স্টক মিলিয়ে দেখেছি ১৭৬ বস্তা চাউল থাকার কথা থাকলে পাওয়া গেছে মাত্র ১০২ বস্তা চাউল।
অভিযুক্ত ডিলার মাসুদ রানা বলেন, আমি কোন অনিয়ম করিনি। যারা টাকা নিয়ে এসেছিল তাদের চাউল দিয়েছে। আর যারা টাকা ছারা বিনা পয়সায় নিতে চেয়েছিল তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে দিয়েছি পরে টাকা জোগার করে আসার জন্য।
শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মোঃ মাহমুদুল হোসাইন খান ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোঃ সামসুজ্জামান খান গড়াইনিউজ২৪.কম শরীয়তপুর প্রতিনিধি আবু রায়হান (বর্ষন) এর সাথে এ বিষয়ে আলাপকালে বলেন, সরকারের এই মহৎ উদ্যোগকে কেউ বাধাগ্রস্ত করলে তাদের কাউকেই ছাড় দেয়া হবেনা। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যথাযথ তদন্তে তারা দোষি প্রমানিত হলে তাদের ডিলারশীপ বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
যে সকল মানুষ দু’বেলা খাবার সংগ্রহ করেত সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত হাড় ভাঙ্গা খাঁটুনিতে নিজেকে বিকিয়ে দেয়, এমন হাজার হাজার মানুষ সরকারের এই ন্যায্যমূল্যের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ক্ষমতাশীন দলীয় নেতা, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারেরা গরীব মানুষের নাম বাদ দিয়ে তাদের স্বচ্ছল সমর্থক ও আত্মীয় স্বজনদের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে। শরীয়তপুরের সুশীল সমাজ দাবী করছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারি এই দরিদ্র বান্ধব কর্মসূচির সফলতা কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছাতে হলে ক্ষমতাশীনদের চরিত্র পরিবর্তন করে, সকল অনিয়মের বেড়াজাল ছিন্ন করতে হবে।