টঙ্গীতে টাম্পাকোর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি ১২ ঘণ্টায়ও

0
1081

গড়াইনিউজ২৪.কম::গাজীপুরের টঙ্গীতে প্যাকেজিং কারখানা টাম্পাকো ফয়লসে আগুন ১২ ঘণ্টায়ও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। বিকালের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পরে আবার দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। দমকল কর্মীরা বলছে, কারখানার ভেতরে বিপুল সংখ্যক রাসায়নিক থাকায় আগুন পুরোপুরি নেভানো যাচ্ছে না। কারখানাটিতে আগুনে এখন পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যুর নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ভেতরে আর কয়জন আটকা পড়েছিলেন, সে বিষয়ে কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কারখানাটিতে ফয়েল পেপার ও কেমিক্যাল-জাতীয় দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ভোর পৌনে ছয়টার দিকে কারখানাটিতে বিস্ফোরণের আগে আগেও ভেতরে বেশ কজন শ্রমিক ঢুকেছিলেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। রাতের শিফটে কত জন লোক ছিল সেটাও নিশ্চিত নয়। ফলে প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই কারখানাটি সিলেটের গোলাপগঞ্জ আসনে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনের। তার প্রতিষ্ঠানে বিস্ফোরণের পর আগুনে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হলেও তিনি বা তার পক্ষের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই ঘটনাস্থলে যাননি। স্থানীয় প্রশাসন যোগাযোগ করেও তাকে পায়নি। বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল মালিকপক্ষের ‘গাফিলতি’ নিয়ে কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কারখানা মালিকের যদি গাফিলতি থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধ কঠিন আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই ঘটনায় নিয়মিত মামলা হবে, তদন্তের পর কী কী ধারা দেয়া যায়, তা দেয়া হবে।’ আইজিপি বলেন, ‘কারখানার মালিক দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই এই ধরনের ইন্ডাস্ট্রি করা ঠিক হয়নি তার। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের পর কেঁপে ওঠে গোটা এলাকা
ঈদের আগে শেষ কর্মদিবসের কাজ চলছিল। কথা ছিল শিফট শেষেই বেতন বোনাস দেয়া হবে। আর এ নিয়ে বাড়ি ফিরবে সবাই। কিন্তু তা আর হলো না। ভোরের আলো ফোটার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে নিভে গেলো কর্মীদের স্বপ্ন। স্থানীয়রা জানান, ভোরে ওই বিস্ফোরণের কাঁপুনি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে,ভূমিকম্প ভেবে আতঙ্কে পরিবার পরিজন নিয়ে অনেকে ঘরের বাইরে চলে।বাইরে বের হয়ে এসেই সবাই কালো ধোঁয়া উঠতে দেখে। এরপরই জানা যায় টাম্পাকোতে বিস্ফোরণের খবর। পরে সবাই ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। কিন্তু ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণ সাধ্যের বাইরে চলে যায়। পরে কারখানার ভেতর আটকে পড়াদের বের করে আনতে কাজ শুরু করেন স্থানীয়রা। এরপর আসে ফায়ার সার্ভিস। শুরু হয় আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। টঙ্গী ছাড়াও এতে যোগ দেয় আশুলিয়া, গাজীপুর,উত্তরাসহ ঢাকার আশপাশে দমকল বাহিনীর ইউনিট। তবে আগুনের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে, ২০টি ইউনিটও হিমশিম খেয়েছে তা নিয়ন্ত্রণে।

তবে উৎসুক জনতা আশেপাশে ভিড় করে থাকায় উদ্ধার কাজে বিঘ্ন তৈরি হয়।কারখানাটির পাশদিয়ে যাওয়া রেল লাইনেও জনতা অবস্থান নেয়ায় ট্রেন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে।

ঘটনাস্থলে যখন আগুন নেভানোর চেষ্টা তখন আশপাশের মানুষ আহতদের নিয়ে ছুটতে শুরু করেন হাসপাতালে। অনেককে নিয়ে আসা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কেউ কেউ হাসপাতালে আসার পর মারা গেছেন। অনেককে নেয়া হয় টঙ্গী হাসপাতালে।

ধসে পড়লো ছিমছাম ভবনটি

বিস্ফোরণের পর পর ভবনটির একটি অংশ ধসে পড়ে। এরপর ধরে আগুন। বাড়তে থাকে অজানা আশঙ্কা। কারণ তখনও ভেতরে আটকে ছিলেন অনেক শ্রমিক।

কারখানার কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় পুরো বিসিক এলাকা। স্বজনদের আহাজারিতে গোটা এলাকার পরিবেশ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, আগুনের পর পর পঞ্চম তলা ভবনের চতুর্থ তলায় বেশ কিছু শ্রমিক জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাদের বাঁচানোর আকুতি জানাতে থাকে। এসময় স্থানীয়রা মই নিয়ে বড় হাতুরি দিয়ে দেয়াল ভেঙে শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে ধোঁয়া ও তাপের কারণে তাদের ওই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণ পরে ওই তলায় থাকা শ্রমিকদের আর কোন সাড়া মেলেনি। আগুন দ্রুত পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে এবং কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী বের হতে থাকে। এতে ওই এলাকার আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

সময় বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে আগুনের তীব্রতা। এক পর্যায়ে ভবনটির একটি দেয়াল ভেঙে যায়। পরে আগুন ছড়িয়ে পরে পাশের অন্য একটি ভবনে। এক পর্যায়ে আগুনে পাঁচতলা ভবনটির ওপরের তিনতলার অনেকটাই ধসে পরে।

তিনটি তদন্ত কমিটি

আগুনের ঘটনা তদন্তে মোট তিনটি কমিটি করা হয়েছে। এর একটি করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে, একটি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি বিসিকের পক্ষ থেকে।

বিসিকের তদন্ত কমিটিতে সাত দিনের মধ্যে, ফায়ার সার্ভিসের কমিটিতে ১০ দিনের মধ্যে জেলা প্রশাসনের কমিটিতে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ক্ষতিপূরণ দিয়ে দুই ঘোষণা

ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু নিহতদের প্রত‌্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের দেখতে এসে শ্রম পরিদপ্তরের পরিচালক এফ এম আশরাফুজ্জামান জানিয়েছেন নিহত প্রত্যেকের পরিবার পাবে দুই লাখ টাকা করে আর আহতরা পাবেন এক লাখ টাকা করে।

এর বাইরে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম জানান, দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ ছাড়াও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের দাফনের জন্য ২০ হাজার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।