ফিঙ্গার প্রিন্টে পরিচয় মিলেছে নিহত ৭ জঙ্গির

0
2541

ঢাকা অফিস : ঢাকার কল্যাণপুরে ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযানে নিহত ৯ ‘জঙ্গির’ মধ্যে সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে পুলিশ। গতকাল বুধবার রাতে তাদের ছবি ও ঠিকানা প্রকাশ করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। ছবি দেখে তাদের দুজনের পরিচয় দিনেই নিশ্চিত করেছিল পরিবার। যে সাতজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে তারা হলেন- দিনাজপুরের ভল­বপুর থানার নবাবগঞ্জ গ্রামের সোহরাব আলীর ছেলে আবদুল­াহ, পটুয়াখালীর কুয়াকাটার নুরুল ইসলামের ছেলে আবু হাকিম নাইম, ঢাকার ধানমন্ডির রবিউল হকের ছেলে তাজ-উল-হক রাশিক, গুলশানের সাইফুজ্জামান খানের ছেলে আকিফুজ্জামান খান, ভাটারার তৌহিদ রউফের পুত্র সেজাদ রউফ অর্ক, সাতক্ষীরা তালা উপজেলার নাসির উদ্দিন সরদারের পুত্র মতিয়ার রহমান, নোয়াখালীর সুধারামের আবদুল কাইয়ূমের পুত্র মো. জোবায়ের হোসেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে নিহতদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের তথ্য ভান্ডার থেকে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি দুই জনের এখনও পরিচয় মেলেনি।

সেজাত রউফ অর্ক ও জোবায়ের হাসানের পরিবার দাবি করেছে চলতি বছরের শুরুর দিকে তারা নিখোঁজ হয়। এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও করা হয়েছিল পরিবারের পক্ষ থেকে। অর্ক নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলো। গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় হামলায় জড়িত নিবরাস ইসলামের বন্ধু অর্ক এক সঙ্গে একটি মামলার আসামিও।  জোবায়ের হাসান নোয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। যে ছবি দেখে  জোবায়েরের পরিচয় নিশ্চিত হন তার বাবা একই ছবি দেখে তা নিজের ছেলে সাবিবরুল হক কণিক বলে দাবি করেন চট্টগ্রামের আজিজুল হক। তার ছেলেও পাঁচ মাস ধরে নিখোঁজ। তবে ওই ছবি  জোবায়েরের বলে নিশ্চিত হওয়ায় আজিজুল হকের দাবির বিষয়টি গতকাল পর্যন্ত পরিষ্কার হওয়া যায়নি। এদিকে নিহত নয়জনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগের পিছনের দিকে গুলি  লেগেছে। এবং তাদের শরীরে গড়ে সাত থেকে আটটি গুলির চিহ্ন ছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের পর ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান ডিএনএ ও  কেমিক্যাল টেস্টের জন্য রাখা হয়েছে লাশের নমুনা। তাদের সবার শরীরে গুলির চিহ্ন পেয়েছি এবং গুলির আঘাতেই প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে। এক একজনের শরীরে এক এক স্থানে গুলির আঘাত ছিল। কারও মাথায়, কারও বুকে, কারও ঘাড়ে, কারও পেটে, কারও হাতে এবং কারও পায়ে। প্রত্যেকের শরীরে গড়ে ৭ থেকে ৮টা করে গুলি লেগেছে। পেছন দিক থেকেই বেশি ইনজুরি ছিল। এ ছাড়া সামনের দিক এবং পাশ থেকেও গুলির আঘাত ছিল। তবে খুব কাছ বা দূর থেকে নয়, মাঝামাঝি দূরত্ব থেকে তাদের গুলি করা হয়েছে। ৯ জনের শরীর থেকে আমরা ৭টা গুলি উদ্ধার করেছি। গুলিগুলো পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতরা কোনো ড্রাগ বা শক্তি বর্ধক ওষুধ শরীরে নিয়েছিল কি-না তা নির্ণয় করার জন্য আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। একই সঙ্গে ডিএনএ ও কেমিক্যাল টেস্টের জন্যও আমরা নমুনা সংগ্রহ করেছি। ডিএনএ ও কেমিক্যাল এনালাইসিস রিপোর্ট পাওয়ার পর জানতে পারবো তারা কোনো ড্রাগ নিয়েছিল কিনা। এরই পরীক্ষাগুলোর জন্য সংগ্রহকৃত নমুনা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে দেয়া হবে। তারা পরীক্ষার পর প্রতিবেদন আমাদের কাছে দিলে তারপর আমরা চূড়ান্ত মতে  পৌঁছতে পারব। এই রিপোর্টগুলো আসার পর ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন  দেয়া হবে বলে জানান তিনি। পরিচয় শনাক্ত হওয়া আবু হাকিম নাইমের পটুয়াখালীর কুয়াকাটার ঠিকানা দেয়া হলেও স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধানে জানা  গেছে তিনি চাকরির সূত্রে ওই এলাকার ভোটার হয়েছিলেন। তার আসল বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে।

হাসপাতালে অর্কের বাবাঃ সেজাদ রউফ অর্কের পরিচয় নিশ্চিত করেন তার বাবা তৌহিদ রউফ। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা তৌহিদ গতকাল মর্গে লাশ শনাক্তের জন্য যান। তবে তিনি চিকিৎসকদের জানিয়েছিলেন তার ছেলেকে শুকনা মনে হচ্ছে। পুরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকরা ডিএনএ টেস্ট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ সময় তার সঙ্গে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক কর্মকর্তাও ছিলেন। অর্ক যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন বলে জানা গেছে। অর্ক গত ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকার বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেননি। পরে ভাটারা থানায় ছেলে নিখোঁজের বিষয়ে জিডি করেছিলেন তৌহিদ।

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালানোর পর কমান্ডো অভিযানে নিহত নিবরাস ইসলামের সঙ্গে অর্ক মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটিতেও পড়াশোনা করেছেন। নিবরাসও ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। গুলশানের ঘটনার পর জানা যায়, তিনি ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঝিনাইদহের একটি মেসে ছিলেন। ওই  মেসে নিবরাসের আরেক সঙ্গী আবীর রহমানও ছিলেন, যিনি ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন শোলাকিয়ায় পুলিশের উপর হামলা চালানোর পর গুলিতে নিহত হন। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সি ব­কের ৩০৪ নম্বর বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন তৌহিদ রউফ।

২৫ শে মে থেকে নিখোঁজ জোবায়েরঃ কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গি জোবায়ের  হোসেনের বাড়ি নোয়াখালীর সদর উপজেলার কাদির হানিফ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডে। বুধবার দুপুরে সুধারাম মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন এ তথ্য জানান। আনোয়ার হোসেন জানান, কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গিদের মধ্যে জোবায়েরের বাড়ি পশ্চিম মাইজদী গ্রামে। জোবায়েরের মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য তার পরিবারের লোকজনকে ঢাকা পাঠানো হচ্ছে। পরে বিস্তারিত জানা যাবে। পুলিশের বিশেষ শাখার অনুসন্ধানের তথ্য মতে, চলতি বছরের গত ২৫ শে মে নিখোঁজ হয় নোয়াখালীর সদর উপজেলার পশ্চিম মাইজদীর আব্দুল্যাহ মেম্বার বাড়ির আবদুল কাইয়ুমের ছেলে ও  নোয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র  জাবায়ের হোসেন। নোয়াখালী পুলিশ সুপার ইলিয়াছ শরীফ জানান, জুবায়ের  হোসেন নিখোঁজের পর একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছিল ১২ই জুলাই সুধারাম থানায়। এ ছাড়া পুলিশ জেলার বিভিন্ন থানায় নিখোঁজ পাঁচজনের একটি তালিকা করলেও শুরু থেকে জোবায়েরকে নিয়ে তাদের একটি সন্দেহ কাজ করছিল। বিষয়টি তারা তদন্তও করছিলেন।

কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত দিনাজপুরের আব্দুল­াহ (২২) দীর্ঘ ৬ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। আব্দুল­াহ দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের বল­বপুর গ্রামের সোহরাবের ছেলে। পেশায় রাজমিস্ত্রি সোহরাবের তিন ছেলে এক মেয়ের মধ্যে আব্দুল­াহ ছিল সবার বড়। আব্দুল­াহ রাজশাহীতে তার আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে এক মাদরাসায় পড়ালেখা করত। দীর্ঘ ৬ মাস ধরে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। নবাবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইসমাইল হোসেন জানান, বুধবার রাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আব্দুল­াহর পরিচয় জানালে পুলিশ তাদের বাড়িতে যায়। তবে আব্দুল­াহর পিতাকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।

এদিকে সাতক্ষীরার উপজেলার নাসির উদ্দিন সর্দারের ছেলে মতিয়ার রহমান এলাকায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে। সে ঢাকায় খালার বাসায় থেকে একটি গার্মেন্ট কারখানায় চাকরি করত। বাড়িতে তার যাতায়াত কম ছিল। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সে ছিল সবার বড়।