আমরা ক্ষমতার কাছে নাকি মনুষ্যত্বের কাছে অপারগ?

0
1236

কোন ভূমিকাই না গিয়ে সরাসরি ঘটনায় চলে গেলাম। কখন মানুষ ভূমিকা ছাড়া কথা বলে জানেন? যখন সে খুব ব্যথিত অথবা খুব খুশি হয়। আমি কোন জায়গা থেকে কথাগুলো লিখছি সেটা না হয় একটু পরেই বলি, তার আগে আপনাদের কিছু ঘটনা মনে করিয়ে দিই।
ঘটনা (১): সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় বিচারের নামে বাঁশের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে ঝুলিয়ে যুবককে পেটালেন ইউপি সদস্য। ভাবছেন এ ঘটনা তো অনেক আগের এখন কেন বলছি? ব্যাখ্যা করছি একটু অপেক্ষা করুন।
ঘটনা (২): কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানাধীন ঢেমুশিয়া ইউনিয়নে বাবার সমতুল্য এক বৃদ্ধকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করেছিলেন এক যুবলীগ নেতা।
ঘটনা (৩): নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলার ১নং ছাতারপাইয়া ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি চেয়ারম্যান ছাতারপাইয়া পূর্বপাড়া গ্রামে এক প্রেমিক-প্রেমিকাকে ঘটনাস্থলে ধরে তাদের বিবাহ দিয়ে দেন। এই পর্যন্ত যা ছিল সব ঠিক ছিল, তাহলে এটা নিউজ হলো কিভাবে ভাবছেন তো? সব ঠিক ছিল কিন্তু ভাইরাল হলো তখনই যখন তাদের গলায় ফুলের মালার পরিবর্তে জুতার মালা দেওয়া হলো।
ঘটনা (৪): এবার একটু অন্য রকম ঘটনা বলি। মানুষের সাথে মানুষের ঝগড়া বিবাদ মারামারি হবে সাধারন ঘটনা, কিন্তু গরু গায়ে অ্যাসিড?
ঘটনা (৫): এটা খুবই আলোচিত ঘটনা, গর্ভবতী হাতিকে আনারসের ভিতরে বোমা দিয়ে মেরে ফেলা। ঘটনাগুলো আমি বিশ্লেষণ করছি না কারণ এই ঘটনাগুলি খুবই সা¤প্রতিক। এখন মূল কথায় আসি কেন এই ঘটনাগুলি পুনরাবৃত্তি করলাম। একটু লক্ষ্য করে দেখুন ৪নং এবং ৫নং এই দুটি ঘটনা একটু ব্যতিক্রম। কিন্তু একটা বিষয় খুবই পরিষ্কার সবগুলো ঘটনাই মানুষের দ্বারা ঘঠিত। ঘটনাগুলি একটু পর্যবেক্ষণ করলে যা দাঁড়ায়।
* কিছু মানুষের ক্ষমতার অপব্যবহার।
* কিছু নোংরা মনের পরিচয়।
* সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে সরে যাওয়া।
* মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটা।
* আবেগ অনুভূতিকে বন্দী করা।
দেখুন বিচারের নামে যে যুবকের হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে মারলেন সেখানে প্রচুর জনগণ উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কি একজন ব্যক্তিও ছিলেন না এর প্রতিবাদ করার। তবে কি ক্ষমতার কাছে এত মানুষ হেরে গেলেন? আর সেটা না হয় বাদ দিলাম, আপনার সামনে আপনার বাবা সমতুল্য একজন বৃদ্ধকে উলঙ্গ করে নির্যাতন করেছে আর আপনি তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। কিভাবে দাঁড়িয়ে দেখছেন, তাহলে ধরে নিলাম আপনিও নোংরা মনের মানুষ তাই হজম করতে পেরেছেন। সেখানেও বহু লোকের সমাগম ছিল তাহলে কি নোংরা মনের মানুষের দেশটা ভরে গেছে। ধরে নিলাম আপনি এখানেও অপারগ। এই পৃথিবীতে ভালোবাসা তো আর খারাপ কিছু নয়। যদি কোন প্রেমিক যুগলকে গ্রামের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য হাতেনাতে ধরে তাদের বিয়ে দেন এটা খুবই ভালো কাজ হবে গ্রামবাসীর জন্য। তাহলে বিয়ের মতো এত পবিত্র একটা কাজে ফুলের মালার বদলে জুতার মালা কেন? এখানে তাহলে কি এখানেও এত মানুষ ক্ষমতার কাছে হেরে গেলেন, নাকি মনুষ্যত্বের কাছে? এই পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে আর কি দরকার আছে ৪ ও ৫ নম্বর বিশ্লেষণ করা। যদি এই ঘটনাগুলো ক্ষমতার কাছে হেরে যায় তাহলে গরুর গায়ে এসিড এবং গর্ভবতী হাতিকে বোমা দিয়ে মারা কিসের কাছে হেরে যাওয়া বলবো।
আর আমি যদি বলি সবগুলো ঘটনাতেই আমাদের মনুষ্যত্ব ও আবেগ-অনুভূতি বিবেক সবই আমরা মাটি চাপা দিয়েছি। অবশ্যই এটা বললে ভুল হবে তাহলে যারা এই কয়দিন ফেসবুকে যে আবেগ অনুভূতির ঝড় তুলেছিলেন তারা তো আমাকে ছেড়ে কথা বলবেন না…
প্রিয় ফেসবুক প্রেমী, এবার আমি আপনাদেরকে বলছি, এই ঘটনাগুলি যখন ঘটেছিল তখন আপনি কোন বিবেকে ভিডিও করছিলেন, সেটা ভাইরাল করার জন্য? আপনারা কেমন মনের পরিচয় দিলেন। তাই আপনার বিবেক মনুষ্যত্ব কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আটকে দিয়েছেন। আমার মনে হয়, যে অন্যায় কাজ করছে তার থেকেও বড় অন্যায়কারী যে এই পুরো ঘটনা ভিডিও করেছে। যদি আপনার কিছু করার নাই থাকে তাহলে আপনি চলে (ঘরে) আসুন, এটা হবে আপনার নীরব প্রতিবাদ। তা না করে আপনি সেটা আপনার পেজে পোস্ট দিলেন, আর আমরা প্রতিবাদী ফেইসবুক বন্ধুরা কি আহাজারি না করছি। এই ফেসবুক পেজে কত কত আবেগী কথা বলছি, কি জ্ঞানী কথা লিখছি, এমন ভাব যদি আমি সেখানে থাকতাম তাহলে……….?
থাক ভাই সমাজটাকে পাল্টানোর জন্য, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য আপনাকে ঘটনাস্থলে যেতে হবে না, শুধু একটু নিজের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলান।
ছোট্ট একটা ভবিষ্যৎবাণী করি, দেখা গেল আপনার বাড়ির কেউ কোন অঘটন ঘটাতে যাচ্ছে, সৌভাগ্যক্রমে হোক বা দুর্ভাগ্যক্রমে হোক আপনি দেখে ফেললেন, আপনার মুভমেন্টটা তখন এমন হলো.. দ্বারা দ্বারা একটু ভিডিও অন করি, তারপর শুরু কর, আপনার ধারণ করা শেষ, যথারীতি ফেসবুকে আপলোড। আপনার বন্ধুদের কমেন্টস আল­াহ কিভাবে হলো এমন, খুবই দুঃখজনক (ইন্নালিল­াহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন..)।
এসব দেখার পর যদি আপনার মনুষ্যত্ব, আবেগ, অনুভূতি জাগ্রত হয় তাহলে সে বিবেক জাগ্রত না হওয়াই ভালো। আমরা এমন কোন ঘটনার সাক্ষী হতে চাই না, যেখানে একসাথে অনেক মনুষ্যত্বের মৃত্যু হয়। এমন কোন মনুষ্যত্বহীন কাজ না করি যেটা আমাদেরকে অনেক ছোট করে। টেকনোলজি আমরা ভালো কাজে লাগাই, ভাইরাল করার জন্য এমন জঘন্য কোন কাজের সাক্ষী যেন না হয়ে যায়।
ভাইরাল করি এমন কোন কিছু যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর গোছানো একটা দেশ গড়তে সাহায্য করবে। তাইতো এই গানটা মনে পড়ছে-
“আজকের শিশু পৃথিবীর তরে এসেছে
আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই”।
আমাদের সবারই সুন্দর একটা মন আছে। সেটাতেই একটা সুন্দর বাগান তৈরি করি, দেশটা এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে।

নিলুফা আক্তার
লেকচারার: AIBT 
পার্টনার: touchshopbd