এভাবে কেন ‘গরিবের কপাল পোড়ে, ভাই?’

0
1277
ফাইল ছবি

জান্নাতুল ফেরদৌস প্রিয়ন্তী,গড়াইনিউজ ২৪.কম: আগুনে শুধু ঘর পোড়ে না, পোড়ে না শুধু বস্তি। পোড়ে অনেক স্বপ্ন, পোড়ে অনেক স্বস্তি। তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন যখন পুড়ে যায় চোখের পলকে, তখন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। তাকিয়ে ছিলেন নান্টু মিয়াও। চোখের সামনে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তখন আগুন নেভাচ্ছে। কাঠকয়লার ভিড়ে ভাসছে নান্টুর একরাশ পোড়া স্বপ্ন। এই চিত্র সোমবার (৭ জুন) ভোরের। স্থান- রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তি। যেখানে পাঁচ বছরে ঘামে-শ্রমে-প্রেমে তিলে তিলে নান্টু বুনেছেন কুটির শিল্পের স্বপ্ন। ফুলদানি, খেলনা, পাপস, জায়নামাজ, ঝুড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন তিনি। আর স্বপ্ন দেখেন বড় কুটির শিল্প গড়ে তোলার। এই স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখা নয়, বরং এই স্বপ্ন তাকে ঘুমাতে দেয় না বলা যায়। কঠোর পরিশ্রমে তাই ধীরে ধীরে স্বপ্ন পূরণের দুয়ারে প্রায় পৌঁছে গেছেন নান্টু। কিন্তু দুয়ার খোলার আগেই ভয়ঙ্কর আগুনের তাপে বস্তিবাসী নান্টু বুঝতে পারলেন, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে’। ভুক্তভোগী নান্টু মিয়ার বাড়ি বগুড়ার সাড়িয়াকান্দিতে। থাকেন সাততলা বস্তিতে। কান্না জড়িত কণ্ঠে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এই জায়গায় পাঁচ বছর থাকি। আমার পাঁচ বছরে তিলে তিলে গড়া কুঠির শিল্পের ব্যবসা। নিজেরাই বাস্কেট, ফুলদানি, খেলনা, পাপস, জায়-নামাজ তৈরি করি ভাই। মহাখালীতে বিক্রি করি। বড় একটা কুঠির শিল্প গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে সপরিবারে কষ্ট করে যাচ্ছিলাম। এক ভোরের আগুনে মাল-সামানা, কাঁচামাল সব পুড়ে ছাই। ‘গরিবের কপাল এভাবে কেন পোড়ে, ভাই?’- প্রশ্ন নান্টুর। ধরা গলায় বললেন, কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা আর নেই। তিনি বলেন, বাইরে ব্যবসা করি। এখানে বাসায় কুঠির শিল্পের মাল-সামানা রাখি। করোনার মধ্যে দুই লাখ টাকার মাল কিনেছি। লাখ টাকার উপরে ছিল নগদ টাকা। ভাবছিলাম মহাখালীতে একটা শো-রুম দেবো। খেয়ে- না খেয়ে সেই স্বপ্নের জন্য বস্তিতে কষ্ট করে থেকে সব গুছাচ্ছিলাম। কিন্তু আগুন আমার সব শেষ করে দিল। আসবাবপত্র-ব্যবসার মালামাল কিচ্ছু বের করতে পারি নাই। আমি তো ভাই নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সোমবার ভোর ৪টার দিকে সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আগুন ভয়াবহ রূপ নিলে আরও চারটি ইউনিট যোগ দেয়। একযোগে ৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। পরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড সামলাতে ফায়ার সার্ভিসের মোট ১৮টি ইউনিট কাজ করে। অগ্নিকাণ্ডের আড়াই ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। প্রত্যক্ষদর্শী বস্তিবাসীদের অভিযোগ, বস্তির পশ্চিম-দক্ষিণ কোন থেকে গ্যাসের লাইন থেকে আগুনের সূত্রপাত। প্রথমে বালি চাপা দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বাসিন্দারা। এতে আগুন না নিভে বরং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বস্তির উত্তর-পূর্ব দিকে। আগুনে পুড়ে যায় দেড় শতাধিক ঘর। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির বাসিন্দার দাবি, আগুনে সব পুড়ে ছাই গেছে। অধিকাংশ মানুষই সন্তান কোলে এক কাপড়ে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে। পুড়ে কয়লা হওয়া ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন পটুয়াখালীর বাউফলের কোহিনূর বেগম। তার স্বামী হারুন রিকশা চালান। কোহিনূর বাসাবাড়িতে কাজ করেন। শাশুড়ি, সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে তার দুই ঘরে আট সদস্যের সংসার। রাতে সবাই এক সাথেই ঘুমিয়েছিলেন। সকালেই দেখলেন পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই তাদের। ঠাই হয়েছে ছাদহীন আকাশের নিচে। কোহিনূর বলেন, আগুন থেকে নিজে বাঁচমু নাকি মাল-সামানা রক্ষা করমু? আগুনে সব শেষ, টাকা পয়সা। কিচ্ছু কওনের নাই। সারা জীবন কষ্ট করেই গেলাম। আল্লাহ তাও কাইড়া নিল।  তিনি বলেন, আগুন লাগলে শুধু জানডা নিয়ে বের হইছি। কিচ্ছু বের করতে পারি নাই ঘর থেইকা। সব পুড়ে গেছে। সমিতি থেইকা নেওয়া ঋণের কিস্তি দিতে আট হাজার টাকা রাখছিলাম, সেইডাও পুড়ছে। আগুনের খবরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, অবৈধ গ্যাস ও বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, বস্তিতে টিনের ঘর অনেক বেশি সেপারেশন হওয়ায় আমাদের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আমাদের ১৮টি ইউনিট কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত আগুনে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে বলে আমরা ধারণা করছি। ঘরে থাকা আসবাবপত্র পুড়ে গেছে। আগুনের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানে প্রচুর পরিমাণে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করছি, এই দুটির যেকোনো একটির কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। ঘনবসতি দাহ্য বস্তু বেশি থাকায় আগুনটা বেশি ছড়িয়েছে। তিনি বলেন, আগুনের কারণ অনুসন্ধানে একজন ডেপুটি ডিরেক্টরের (ডিডি) নেতৃত্বে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানে আগুনের প্রকৃত কারণ বেরিয়ে আসবে বলে আমরা আশা করছি। ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট পাঁচ বার পুড়েছে সাততলা বস্তি। ২০১২, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর রাজধানীর এ বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রতিবারই গ্যাস অথবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। আজকের অগ্নিকাণ্ডও অবৈধ গ্যাস সংযোগের লিকেজ থেকে হয়েছে বলে দাবি বাসিন্দাদের। এ বিষয়ে সাততলা বস্তির বাসিন্দা শফিয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে বস্তির দক্ষিণ পাশে একটি ঘরে রান্নার কাজ চলছিল। চুলা থেকে হঠাৎ করে গ্যাস লিকেজ হয়ে আগুন ছড়ি পড়ে সারা ঘরে। আগুন লাগার পর ঘরের মানুষজন আগুন আগুন বলে চিৎকার শুরু করলে কোনো মতে জীবনটা নিয়ে বের হই। বস্তির আরেক বাসিন্দা ইয়ামিন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাগো বস্তির সব থেকে খারাপ জিনিস হইল গ্যাসের লাইন। দুই দিন পর পর শোনা যায় বস্তির ভেতরে ওই জায়গায় গ্যাস লিকেজ হইছে, ওই ঘরের গ্যাস লাইন থেকে গ্যাস বের হচ্ছে। পরে যারা গ্যাস দিয়েছে তাদের জানাইলে তারা আইসা কোনোমতে প্লাস্টিক দিয়া জোড়াতালি দিয়ে লিকেজ বন্ধ কইরা যায়। পরে আবার সেই প্লাস্টিক উইঠা গেলে আবারও লিকেজ শুরু হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে সাততলা বস্তি। তারা কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দিয়েছে সাততলা বস্তিতে। প্রতিঘর থেকে গ্যাস সংযোগবাবদ চক্রটি হাজার টাকা করে নিচ্ছে। বস্তির প্রায় ১ হাজার ঘর থেকে টাকা তুলছে তারা। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির এক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের বস্তিটি পরিচালিত হয় স্থানীয় রাজনৈতিক লোকদের দ্বারা। যখন যে দলের সরকার থাকে তখন সেই দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা বস্তিটি নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই মূলত বিদ্যুৎ অফিস ও তিতাস গ্যাসের সঙ্গে যোগসাজশ করে আমাদের বস্তিতে অবৈধ সংযোগ দেয়। মাঝে মধ্যেই গ্যাস লাইনে লিকেজ হয়। আমরা খবর দিলে স্থানীয় নেতারা ম্যাকানিক এনে রাবার দিয়ে লাইন ঠিক করে যায়। কয়েক বছর বারবার আগুন লাগায় গ্যাস লাইনের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবি করলে তারা নিজেদের গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে আমাদের হুমকি দেয়। আবার অনেক সময় মারধরও করে। বস্তিবাসী অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। ভয়ে কেউ কিছু বলে না। আর সরকারের পক্ষ থেকেও কেউ আসে না অবৈধ গ্যাস সংযোগের খোঁজ নিতে।