মরণবাঁধ ফারাক্কা আমাদের জাতির জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ: অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন

0
3503

১৬ বছর আগে কুষ্টিয়া সদরের সাবেক এমপি অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন একটি বই এ ‘মরণবাঁধ ফারাক্কা আমাদের জাতির জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ’ প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন। কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্থানীয় সরকার বিষয়ক সম্পাদক হিসাবে তিনি রাজনীতি করছেন। তিনি এন্ট্রি ফারাক্কা তৈরি কমিটির আহ্বায়ক। বহুবার সভাসমাবেশে তিনি ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবের কথা বলেছেন। বাস্তবতা এখন সকলের সামনে। ফারাক্কার অশুভ প্রভাবে আমরা নাস্তানাবুদ। অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিনের সে ভবিষ্যৎ বাণী আজ অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। ফারাক্কা যে শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য সমস্যা তা নয়, ভারতের বিহার প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও সম্প্রতি এই বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি করেছেন। সেখানেও জলাবদ্ধতা ও বন্যার অন্যতম কারণ হিসাবে এই ফারাক্কা বাঁধকে চিহ্নিত করা হয়েছে।      

তাই  জনগনের স্বার্থে পাঠকদের জন্য আজ আবার এই প্রতিবেদটি তুলে ধরা হল-

খোদাতায়ালা এই ধরণীতে মানুষ ও জীব-জন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী বিশেষ করে মনুষ্য জাতি এই কঠিন ও নিষ্ঠুর পৃথিবীতে জীবন সংগ্রাম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অভিজ্ঞতা রেখে যেতে পারেন, তার জন্য খোদাতায়ালা এই পৃথিবীতে বেশ কিছু মুল্যবান সম্পদ দান করেছেন। যেমন সুর্য, বাতাস, মাটি, মাটির নিচে বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ও পানি উল্লেখযোগ্য। মনুষ্য জাতি তার প্রয়োজনে এই সব প্রাকৃতিক সম্পদগুলোকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যবহার করে জীবন সংগ্রাম করে টিকে আছে এবং সভ্যতা ও কৃষ্টি গড়ে তুলছে। তবে এই সব মুল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে পানি হলো সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন। কারণ পানি ছাড়া মানুষ এমনকি জীব জানোয়ার, গাছপালা কিছুই টিকে থাকতে পারে না এই ধরনীতে। তাই পানির অপর নাম জীবন। আমরা অতীত ইতিহাস খুঁজে দেখতে পাই, পৃথিবীতে যে সব উল্লেখযোগ্য সভ্যতা গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশ হলো বড় বড় নদীর অববাহিকায়। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে প্রাচীণ মিশরের সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নীল নদের তীরে, হোয়াং হো নদী অববাহিকা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন চায়না সভ্যতা, প্রায় ৪ হাজার বছর পূর্বে। ট্রাইগ্রীস নদীর ধারে বিখ্যাত ব্যবোলিয়ান যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাও প্রায় ৫ হাজার বছর আগে। এই উপমহাদেশে গঙ্গা নদীর কিনারে গড়ে উঠেছিল আর্য সভ্যতা, সিন্ধু নদকে কেন্দ্র করে প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে গড়ে উঠেছিল হরপ্পা ও মহেন্দ্রদারো সভ্যতা। এই সব প্রাচীন ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, জীবন ধারনের জন্যই শুধু পানির প্রয়োজন নয় সভ্যতা ও কৃষ্টি সৃষ্টির জন্যও পানি অপরিহার্য।
আমরা জাতি হিসেবে খুবই সৌভাগ্যবান। আমাদের ক্ষুদ্র দেশটির বুকের উপর দিয়ে প্রায় ৫৪টি নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। আর এই প্রচুর নদ-নদীর জন্য আমাদের দেশটি সবুজের সমারহ। আর এই নদী এবং সবুজের সমারহে আকৃষ্টি হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকের আগমন ঘটেছে। তারা আমাদের প্রচুর নদ-নদী, গাছপালা সবুজের সমারহ দেখে, আদর করে নাম দিয়েছিল গ্রীন-ল্যা । আমাদের দেশের মধ্য দিয়ে যে ৫৪টি নদী প্রবাহিত হয়েছে , তার উৎস ভুমি হলো হিমালয় পর্বত। তাই বাংলাদেশে প্রায় ৯৬ভাগ পানি প্রবাহিত হয়ে আসে ভারত থেকে। এই ৫৪টি নদীর মধ্যে দু’টি হলো আন্তর্জাতিক নদী। একটি পদ্মা (গঙ্গা) এবং অপরটি হলো ব্রহ্মপুত্র নদ। এদের উৎস ভূমি হলো হিমালয় পর্বত। গঙ্গা নদীর উৎপত্তি হয়েছে হিমালয়ের কৈসাল শ্রীঙ্গে। সেখান থেকে এই গঙ্গা নদী নেপালের মধ্য দিয়ে ভারত ভুমির ১৫০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে কুষ্টিয়া মধ্য দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়ে প্রায় ৭০ মাইল দুরে গোয়ালন্দের নিকটে যমুনার সাথে মিলিত হয়ে দক্ষিন দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। অতি আদীকাল থেকে পদ্মা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত প্রায় ৫ কোটি লোক এই নদীর উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এই নদীর পানি ব্যবহার করে কৃষি কাজ করছে, ফসল ফলাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ মাছ আহরণ করে জীবন ধারন করছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নৌকার মাধ্যমে একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর করছে। গৃস্থলীর কাজ কর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে এই নদীর পানি। পর্যাপ্ত নদীর পানি পাওয়ার কারণে পদ্মায় অববাহিকায় প্রচুর খাদ্য শস্য উৎপাদিত হয়। পক্ষান্তের খাবার জন্য পেয়ে আসছে নানা জাতের মাছ। আর সেই কারনেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই একটা কথা প্রচলিত ছিল-“মাছে-ভাতে বাঙালী।”
কিন্তু বড়ই দুর্ভাগ্য, এই অঞ্চলের মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে যে নদীর উপর নির্ভরশীল ছিল, আমাদের প্রজন্মে সময় প্রতিবেশী ভারত গায়ের জোরে আন্তর্জাতিক সমস্ত নিয়মনীতি লংঘন করে, অমানবিকভাবে বাংলাদেশের রাজশাহী সীমান্ত থেকে মাত্র ১১ মাইল দুরে ফারাক্কা নামক স্থানে আমাদের দেশের পদ্মা তাদের দেশের এই নদীর নাম গঙ্গা, এই গঙ্গার উপরে ব্যারেজ নির্মাণ করে প্রকৃতির দান পানিকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের এই পদ্মা অববাহিকাকে মরুভূমিতে পরিণত করছে।
১৯৭৫ সাল থেকে ভারত এক তরফাভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করার ফলে আমাদের এই দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। কৃষক ভাইয়েরা পর্যাপ্ত পানির অভাবে কৃষি কাজ করতে পারছে না। ফলে খাদ্য শস্য উৎপাদন দারুনভাবে ব্যহত হচ্ছে। পানির অভাবে গাছপালা শুকিয়ে যাচ্ছে, আবহাওয়া ও ভৌগলিক পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সুর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রীষ্মকালে এই এলাকাগুলো মরুভুমিরূপ ধারণ করে। নানা রকম নতুন নতুন শারীরিক ব্যাধি আবির্ভাব হচ্ছে। এই সব রোগের সু-চিকিৎসার সন্ধান মিলছে না। নদীতে পানি না থাকার কারণে পানির স্তর ক্রমেই নীচে নেমে যাচ্ছে। অতি কষ্টে টিউবওলের মাধ্যমে খাবার পানি তোলা হচ্ছে। তার অধিকাংশই পানিতেই আর্সেনিক নামক এক ধরণের বিষের সন্ধান মিলছে । নদীতে পানি না থাকার কারণে মাছ শিকারের উপরে যে ৫ লক্ষ লোক জড়িত ছিল, তাদের পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই পদ্মার অববাহিকায় যে মিল কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার উৎপাদন দারুন ভাবে ব্যহত হচ্ছে। যেমন ঈশ্বরদীর পেপার মিল, গ্রীষ্মকালের অধিকাংশ সময় পর্যাপ্ত পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। একই রকম খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল ও গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র মিঠা পানির অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ফারাক্কার অশুভ প্রভাবে পদ্মার পানির চাপ না থাকার কারণেই বঙ্গোপসাগরের লোনা পানি খুলনা যশোর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। এর ফলে এইসব অঞ্চলে চাষ-বাসের জমি লবণাক্ততা ধারণ করার ফলে কৃষিকার্য ব্যাহত হচ্ছে। সুন্দরবনে লোনা পানি ঢুকে যাবার ফলে অধিকাংশ গাছপালা অকালে মৃত্যুবরণ করছে। আমাদের জাতির শক্তির প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ অন্যান্য বনজ প্রাণী মিঠা পানির সন্ধানে ভারতের দিকে পাড়ি জমাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের জন্য মরণ ফাঁদ।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের সমগ্র অর্থনীতি ধক্ষংসের কাঠগাড়ায় দাঁড়িয়েছে। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ বন্ধ রেখে তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন মেটায়। তখন আমরা পানি থেকে বঞ্চিত হয়ে মরূকরণের কবলে পড়ি। আমাদের ফসল ও জীববৈচিত্র পানির অভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।
অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে তাদের পানির অতিরিক্ত চাপ ঠেকাতে ফারাক্কা খূলে দিচ্ছে। এর ফলে আমাদের দেশে কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের কষ্টার্জিত মাঠের ফসল, ঘরবাড়ি, ধ্বংস হচ্ছে। তারা বন্যা থেকে বাঁচতে বর্ষার সময় ফারাক্কা বাধ খুলে দিচ্ছে। তখন আমাদেরও পানির কোন দরকার নেই। বর্ষার কারণে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সবগুলো নদীতে পানি টুইটুম্বর করে। সেখানে ভারত থেকে অতিরিক্ত পানি এসে আমাদের সব কিছু ভাসিয়ে দেয় এবং কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করে। এর ফলে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দেয়। তাদের কারণে আমাদের এই কৃত্রিম বন্যায় বসতবাড়িসহ হাজার হাজার হেক্টর ফসলী জমি নদীতে বিলিত হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ও জীববন্তু বসতি ও আশ্রয় হারা হয়ে ধ্বংস হতে থাকে। প্রায় প্রতি বছরই এ চিত্র আমাদের সামনে আসে।
শুধুমাত্র ভারতের আইন না মানা এবং গায়ের জোরের কারণে আমাদের এ চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। অন্যদিকে মানবিকতার সাথে ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। আমরা মাথা তুলে বিশ্বের বুকে দাঁড়াতে পারছি না তার অন্যতম কারণ এই কৃত্রিম বন্যা বা মরণ বাধ ফারাক্কা।
সোভিয়েত বিজ্ঞানী ডঃ ভ্যালীন ক্রামনিনিকভ অনেক আগেই এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহকে কোনভাবে ব্যাহত করা হলে শত শত বছর ধরে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা ও ভারত সাগরের কিছু অংশে যে পরিবেশগত ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে তা ব্যাহত হবে এবং এই এলাকা জনবসতির জন্য হবে বিপদজনক। তার এই ভবিষ্যদ্বাণী আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
এই মরণ ফাঁদ ফারাক্কা এক দিনে তৈরী হয়নি। এর একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে জন্ম নেয় দু’টি দেশ, ভারত এবং পাকিস্তান। ১৯৫১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গোপন সুত্রে জানতে পেরে, এই মর্মে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, ভারত পশ্চিম বঙ্গের ভাগিরথী নদীর নাব্যতা রাখার কৌশল হিসেবে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার ৫০ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৩০ হাজার কিউসেক পানি সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করছে। এর উত্তরে ভারত সরকার ১৯৫২ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান সরকারকে জানান যে, এই ধরনের একটি পরিকল্পনা প্রাথমিক পর্যায়ে অনুসন্ধান স্তরে আছে এবং পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (আজকের বাংলাদেশ) তার প্রতিক্রিয়া পড়বে না। এরপরে ১৯৬০ সালের ২৮ জুন পাক-ভারত প্রথম আলোচনায় বসে। ৩ জুলাই পর্যন্ত এই আলোচনা চলে। সেই থেকে শুরু গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রন, বন্টন ও কার ভাগে কতটুকুু পানি পড়বে তা নির্ধারণের আনুষ্ঠানিক আলোচনা যা আজও চলছে। উভয় দেশের পানি বিশেষজ্ঞ সচিব, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত আলোচনায় বসেছে। কিন্তু কোন সুরাহা না করেই ভারত ফারাক্কা বাঁধের কাজ শুরু করে। কুট কৌশল ও ষড়যন্ত্রের কালো পথ বেঁেয় পাকিস্তান সরকার গঙ্গার উজানে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আলোচনা টেবিলে রেখে, পাকিস্তানে সিন্ধু নদের পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রন, বন্টন ও সংরক্ষনের সম্মিলিত সিন্ধু অববাহিকা চুক্তি করেন কিভাবে? তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লীতে ১৯৬১ সালে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ঐ ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান মংলা ও তারবালার বাঁধ নির্মান করে, তাদের মরু অঞ্চলে সবুজের সমারোহ ঘটিয়েছে। এই চুক্তির পর পরই ভারত ১৯৬১ সাল থেকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান যদি সিন্ধু নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পায়, তাহলে আমরা কেন গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাব না? ফারাক্কা বাঁধ ১৯৭৪ সাল থেকে পরীক্ষা মুলকভাবে চালু হওয়ার পর থেকে বারংবার আমরা গঙ্গা নদীর ন্যায্য হিস্যা দাবী করে আসছি, কিন্তু ভারত ক্ষমতার জোরে আমাদের এই ন্যায্য দাবী কর্ণপাত করছে না। আসলে ভারত এ ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রন করে আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে চাই। বাংলাদেশের খ্যাতনামা পানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ এম শাজাহান মন্তব্য করেছেন-“পানি এ্যাটেম বোমা এবং হাইড্রোজেন বোমার চাইতেও বড় মরণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহত হতে যাচ্ছে। যারা পানি নিয়ন্ত্রন করবে তারাই হবে বড় অস্ত্রের অধিকারী। এই পানি অস্ত্র থাকলে দেশ জয় করতে তাকে আর যুদ্ধ করতে হবে না।” আসলে ভারত আমাদের বিরুদ্ধে এই পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিল মধুর। তাই বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল ভারত এবার হয়তো গঙ্গার ন্যায্য হিস্যা দেবে। সে হিসেবে ১৯৭২ সালে ভারত বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৪ সালে দিল্লীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর মধ্যে এদেশের পানির ন্যায্য হিস্যা ব্যতিরেকে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তির উপর ভিত্তি করেই ১৯৭৫ সাল ২১ এপ্রিল থেকে ৪১ দিনের জন্য ফিডার ক্যালেনের মাধ্যমে ১৬ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত করার অঙ্গিকার করেছিল।
১৯৭৬ সালে নির্ধারিত সময়ের পরেও ফিডার ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রবাহিত করেনি। উপরোক্ত অব্যাহত ভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। এর ফলে বাংলাদেশে পানি প্রবাহ কমে যায়। ফলে এপ্রিল মাসে ৬৫ হাজার কিউসেকের স্থলে হার্ডিঞ্জ ব্রীজে পানি প্রবাহ নেমে আসে মাত্র ২৩ হাজার কিউসেক। তৎকালীন সরকারের সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের প্রচ্ছন্ন সহযোগীতায় ফারাক্কার প্রশ্নে বাংলাদেশ সিংহ পুরুষ অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কক্তস্বর মজলুম জননেতা মরহুম মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী ফারাক্কার বিরুদ্ধে সারা দেশ ব্যাপী গন-আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৭৬ সালে ১৬ মে ফারাক্কার অভিমুখে ঐতিহাসিক লংমার্চের ডাক দেন। ভারত কর্তৃক ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশকে মরুভুমি করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেই জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছিল, এই লংমার্চের উদ্দেশ্য।
তার এই ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে সমগ্র জাতি সেদিন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ভারত ফারাক্কার মাধ্যমে আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশটিকে অর্থনীতি, পরিবেশ, কৃষিব্যবস্থাসহ সর্বক্ষেত্রে পঙ্গু করার উদ্দেশ্যে ফারাক্কা ব্যারেজকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে চায়। সেই সাথে ভারত বাংলাদেশের জনগনের যে বন্ধু নয়, ফারাক্কা ব্যারেজই তার জলন্ত প্রমান। এর পরবর্তী সময়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতিসংঘের ৩১ তম অধিবেশনে এই সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলিষ্ঠকক্তে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক নদী নিয়ম লংঘন করে গঙ্গা নদীর উজানে বাধ নির্মান করে একতরফা পানি প্রত্যাহার করে, বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় মরুভুমি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে এ অঞ্চলের প্রায় ৪ কোটি লোক আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখিন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই মানবিক সমস্যা সমাধানকল্পে প্রভাব বিস্তারের আহবান জানান। ১৯৭৬ সালে ২৬ নভেম্বর জাতি সংঘের বিশেষ রাজনৈতিক কমিটিতে ফারাক্কা সমস্যার ব্যাপারে ছয় দফা প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরই ফলশ্র“তিতে ভারত সরকার বাংলাদেশের সংগে পানি বন্টনের জন্য ১৯৭৭ সালে ৫ বছর, ১৯৮২ সালে ৩ বছর, ১৯৮৫ সালের ৩ বছর মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুপাতে বাংলাদেশ গ্রীস্মকালে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি আনতে সক্ষম হয়। যাতে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পায় তার জন্য ক্লোজ গ্যারান্টি সম্মিলিত ধারাটিও সংযোজন করা হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বুঝতে সক্ষম হন যে, এই চুক্তির মাধ্যমে ফারাক্কার সাময়িক সমস্যা সমাধান হলেও ভবিষ্যতে এই সমস্যা জিয়েই থাকবে। তাই জিয়াউর রহমান এই জাতির জীবন-মরণ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য বাংলাদেশের পানি বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ আলোচনা করে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য নেপালে জলাধর নির্মানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের প্রস্তাব হলো- গঙ্গা যেহেতু আন্তর্জাতিক নদী তাই পানি সমস্যায় নেপালকে সম্পৃক্ত করে র্বষার সময় অতিরিক্ত পানি নেপালে জলধার নির্মান করে ধরে রাখা আর এই পানি শুস্ক মৌসুমে ছেড়ে গঙ্গার প্রবাহ বাড়ানো। ১৯৮৯ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রনের উপর নেপাল বাংলাদেশ যৌথ সমীক্ষায় দেখা গেছে নেপালে পানি সংরক্ষনাগার নির্মানের মত ৩০টি স্থান রয়েছে। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ শুকনা মৌসুমে গঙ্গার পানির প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য এ ধরনের পানি সংরক্ষনাগার নির্মানের প্রস্তাব দিয়েছিল। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে কোথায় কোথায় এ পানি সংরক্ষনাগার নির্মান করা যেতে পারে তাও নির্দেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, গঙ্গার পানির ৪টি নেপালী উৎসধারার চিসাপানি, কালিগানদাকী ও পঞ্চেশ্বরে ৭টি পানি সংরক্ষনাগার নির্মান করা যেতে পারে। স্বাভাবিক উচ্চতায় এ সাতটি জলধারা নির্মান করলে শুকনো মৌসুমে গঙ্গার ৪৮ হাজার কিউসেক পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা যায়। আর যদি এর মধ্যে সর্বাধিক সম্ভাবনাময় চিসাপানি, সাপ্ট, কোসি, সেটি ও ত্রিসুলাঙ্গা-এ চারটি বাধের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি করা হয় তবে এ ৭টি বাঁধ থেকেই শুকনা মৌসুমে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ কিউসেক পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত বাংলাদেশর এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। দিল্লী পাল্টা বাংলাদেশকে প্রস্তাব করেন শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীতে পানি প্রবাহ বৃদ্ধিকল্পে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে সংযোগখাল নির্মান করা। কিন্তু বাংলাদেশ অনুভব করে, এই প্রস্তাব গ্রহন করা হলে বাংলাদেশে পানি সমস্যা দূর হবে না বরং সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে। পক্ষান্তরে ভারত আরো উপকৃত হবে। তাই ঢাকা দিল্লীর এই প্রস্তাব তাৎক্ষনিক বাতিল করে দেয়।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অনুভব করেন, ভারত শুধু ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রন করতে চায় না দেশের অন্যান্য নদীর উৎসহ মুখে বাঁধ, গ্রয়েন নির্মাণ করে পানি নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছে। তাই শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশের খ্যাতনামা পানি বিশেষজ্ঞদের সাথে সলাপরামর্শ করে এই মারাত্মক সমস্যা সমাধানকল্পে বিভিন্ন নদীতে বাঁধ নির্মান বিশেষ করে পদ্মার উপরে গঙ্গা ব্যারেজের মত একটা বিশাল প্রকল্প গড়ে তোলার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহন করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমেই তিনি বর্ষা মৌসুমে পানি আটকে রেখে গ্রীষ্মকালে কৃষি কাজসহ অন্যান্য কর্মে এই পানি ব্যবহারের চিন্তা করেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার বাহিরচরের নিকটে পদ্মার উপরে ব্যারেজ নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। যেটাকে আমরা অনেকে এন্টিফারাক্কা হিসাবে চিহ্নিত করি। তিনি বাহিরচরে ১৯৮১ সালে ১৮মে এই ব্যারেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কুষ্টিয়া শহরের অবস্থিত জিকে অফিসে তিনি এই ব্যারেজের জন্য আলাদা একটি অফিস নির্মান করেন। এই প্রকল্পের মুল উদ্দেশ্য হলো পদ্মার উপরে একটি ব্যারেজ নির্মান। বর্ষাকালে স্বাভাবিক গতীতে যে পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করবে এই ব্যারেজের মাধ্যমে সেই পানি ধরে রাখা। বলা যেতে পারে, অনেকটা জলাধারের মত। শুস্ক মৌসুমে এই পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা, বিশেষ করে ভেড়ামারায় অবস্থিত জিকে সেচ প্রকল্পের অধিনে এই অঞ্চলে যে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার হেক্টর জমি সম্পৃক্ত সেই সব জমিতে কৃষি উৎপদনের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে লক্ষ লক্ষ মৎস্য শিকারী তাদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ পাবে এবং দেশে মাছের সমস্যা সমাধান হবে। সবচেয়ে বড় কথা এই ব্যারেজ নির্মান হলে এখান থেকে প্রচুর পানি-বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তাতে সমগ্র বাংলাদেশে বিদ্যুৎ চাহিদা মিটবে। সেই সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা পাবে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দৃঢ় পদক্ষেপে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় প্রতিবেশী ভারত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই সাহসী ভূমিকা মেনে নিতে পারেন নি। তাই দিল্লী-কলকাতা তাদের এ দেশীয় দালালদের সহযোগীতায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেন। পরবর্তীতে স্বৈরাচারী হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ব্যানেটের জোরে ক্ষমতায় এসে ভারতের কথা মত গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়। এদিকে ফারাক্কা সমস্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময়ের মধ্যে বেগম খালেদা জিয়া জনগনের রায় নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশের ন্যায্য পানি না দেয়ার কারনে পদ্মা ও তার শাখা নদীগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। ফলে সমগ্র দেশে ফারাক্কার বিরুদ্ধে বিশেষ করে ভারতের বিরুদ্ধে ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন সংগ্রামের সুত্রপাত হয়। কুষ্টিয়ার প্রতিবাদী মানুষ ভারতের এই অমানবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে এবং গঙ্গাবাধ বাস্তবায়ন নামে একটি কমিটি গঠিত হয়, এই কমিটিতে আমাকে এ অঞ্চলের আহবায়ক করা হয়। এই কমিটি পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া, পাবনা, হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নীচে অনেক মিছিল সমাবেশের আয়োজন করা হয়। পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার তৎকালীন বিএনপি সভাপতি মরহুম সৈয়দ মাসুদ রুমী, আমি নিজে এবং সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক কর্মী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে সুগন্ধা অফিসে সাক্ষাৎ করে ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আমাদের অঞ্চলের করুন মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তাকে অবগত করি। আমরা প্রস্তাব করি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিকল্পিত গঙ্গাবাধ বাস্তবায়ন করার। সেই সাথে এই মানবিক বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলার অনুরোধ করি। তিনি ধৈর্য্য সহকারে আমাদের কথা শুনেন এবং গঙ্গাবাধ বাস্তবায়ন করার যুক্তিকতাও স্বীকার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। বেগম খালেদা জিয়া ভারত সফরের সময় সেদেশের সরকার প্রধানকে ফারাক্কার কারনে বাংলাদেশে কি বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা অবগত করেন এবং অনুরোধ করেন বাংলাদেশকে শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি দেবার এবং বাংলাদেশ পুনরায় নেপালে জলাধর নির্মাণে প্রস্তাব দেন, কিন্তু ভারত তাৎক্ষনিক তা নাখোচ করেন। বরং ভারত পদ্মা ব্রাহ্মপুত্র নদীর মধ্যে সংযোগ খালের প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশ নাখোচ করেন। সংযোগ খাল বাংলাদেশের নাখোচ করার কারণ হলো ব্রাহ্মপত্র বেসিনে যে পানি রয়েছে তা প্রয়োজন পুরনের জন্য মোটেই পর্যাপ্ত নয়। এ অবস্থায় গঙ্গা অববাহিকায় থেকে পানি নিয়ে আসার প্রশ্নই উঠে না। তৃতীয়ত ব্রহ্মপুত্রের পানি অন্য বেসিনে স্থানান্তর অর্থনীতি, পরিবেশ ও জনজীবনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এসব কারণে সংযোগ খালের প্রস্তাবকে গ্রহণ করা যায় না।এরপরও প্রশ্ন হতে পারে কেন ভারত এ ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করছে। সংযোগ খালে ভারতের প্রধানত ৩টি স্বার্থ রয়েছে। প্রথম. ব্রহ্মপুত্র নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত সেচের যে সুবিধা পেতে পারে তার তুলনায় ফারাক্কার উজানে গঙ্গায় ফেলতে পারলে তা বেশি লাভজনক হবে। এ পানিকে গঙ্গা-কাবেরী প্রকল্প দিয়ে টেনে নিয়ে ভারত দক্ষিন ভারতের খরাদগ্ধ এলাকাকে সবুজপ্রান্তরে পরিণত করতে পারবে। দ্বিতীয়ত. আসামের সাথে ভারতের মুল ভুখন্ডে যোগাযোগের সমস্যা দীর্ঘদিনের । কলকাতা থেকে দার্জিলিং ঘুরে আসামের রাজ্যগুলোতে যেতে হয়। যোগাযোগের এ অসুবিধার জন্য আসামের বিদ্রোহ দমনে ভারতকে বিভিন্ন সময় প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল হলে পশ্চিমবঙ্গের সাথে আসামের সবচেয়ে সহজ যোগাযোগ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে যদি এ খালকে ভারত ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে তবে তা ভারতের জন্য সুয়েজ খালের মত আর্শীবাদ বয়ে আনবে।
তৃতীয়ত. বাংলাদেশ এতদিন গঙ্গার পানির ব্যাপারে ভারতের উপর নির্ভরশীল ছিল, সংযোগ খাল হলে ব্রহ্মপুত্রের পানির ব্যাপারেও বাংলাদেশকে ভারতের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
যাহোক এর পরেও ভারত বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত পানি না দেওয়ার ফলে পানির অভাবে বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা দারুনভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতিসংঘে ৪৮তম অধিবেশনে ফারাক্কা সমস্যা সম্বন্ধে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করবো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে বিশ্বসভা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান না হওয়ায় দেশের গাছপালা ধক্ষংস হয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে লবনাক্ততা, এই লবণাক্ততার কারণে শিল্প, ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পলি পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নৌ-পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মৎস্য ও পশু সম্পদ বিলিন হবার পথে। এর ফলে পদ্মার উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন পেশার অগণিত মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে। অনেকেই হয়েছে বাস্তবহারা। সারা পৃথিবী যখন পরিবেশ সংরক্ষণে সোচ্চার তখন বাংলাদেশের এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। যা মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের লংঘন। এক কথায় ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যয়ের সম্মুখীন । পানি বন্টন নিয়ে ভারত তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলে, আমাদের দু’দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধিতে আরও বিরাট অবদান রাখতো। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভারতের এই অমানবিক আচরণের বিষয়টি বিশ্বসভা সুরাহা করবে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অবিলম্বে একটি স্থায়ী চুক্তির মাধ্যমে গঙ্গা নদীর পানি সম্পদের ন্যায্য বন্টন সুনিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশ্ববাসী এগিয়ে আসবেন। কিন্তু ভারত তারপরেও বাংলাদেশের ডাকে সাড়া দেয়নি। বরং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতিসংঘে ভাষন দেওয়ার কারণে ভারত চরমভাবে খালেদা জিয়ার উপরে নাখোশ হয় এবং দিল্লী তাদের এদেশীয় অনুগত দলের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদের গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে ভারত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের সেবাদাসী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসান। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দিল্লীর নির্দেশে ৩ মাসের মধ্যে ভারতের সাথে পানি বন্টনের ৩০ বছরের চুক্তি করেন। এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। কিন্তু এই ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক কোন ফোরামে ফারাক্কা বিষয় কোন আলোচনার প্রস্তাব করতে পারবে না। কিন্তু এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার কোন ক্লোজ গ্যারান্টি নেই। ফলে ১৯৯৬ সালে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক পানি তো দুরের কথা শুষ্ক মৌসুমে কোন বছর ৯/১০ হাজার কিউসেকের বেশী পানি বাংলাদেশ পায়নি। এর ফলে বিগত কয়েক বছর পদ্মা গড়াই সহ অন্যান্য শাখা নদীগুলো মরুভুমিরূপ ধারন করেছে। বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যা মারাত্মক রুপ ধারণ করেছে। এরপরেও বিগত সরকার চুক্তি মোতাবেক ভারত পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ না করার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি। এমনকি বিগত সরকার এই চুক্তিকে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। আসলে জাতিসংঘে ৪৮ তম অধিবেশনে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিশ্ববাসীর কাছে ফারাক্কার সমস্যা তুলে ধরে ভারতকে অভিযুক্ত করে যে তেজদ্বীপ্ত ও যুক্তিসংগত ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে ভারত বিশ্ববাসীর কাছে মানবতা বিরোধী একটি জাতি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। তাই ভারত কৌশলে শেখ হাসিনার মাধ্যমে এই ভাওতাবাজীর পানি চুক্তি করে আন্তর্জাতিক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী সরকারও বাংলাদেশের এই স্বার্থ বিরোধী চুক্তি করে ভারতের সাহায্যে নিজেদের গদি রক্ষার চেষ্টা করেছে।
যাই হোক ভারত তাদের এদেশের সার্বিক স্বার্থ হাসিলের জন্য পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে দেশটি ক্রমেই মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় স্বাধীন দেশটি রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পানি বিশেষজ্ঞ জনাব বিএম আব্বাস বলেছেন, গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবীর পেছনে জাতি, ধর্ম ও দল নির্বিশেষে সম্মিলিতভাবে এবং একযোগে সোচ্চার হলে ঐ দাবীকে কোন দেশই রুখতে পারবে না। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের প্রধান শক্তি হচ্ছে তার বিশাল জনগোষ্ঠী। যতকিছুই করা হোক এবং বলা হোক না কেন, এই দাবীর পেছনে আমাদেরকে ইস্পাত-কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে দাঁড়াতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে দেশের জনসাধারণের সম্মিলিত সমর্থন।
ভাটির দেশ হবার অসুবিধার জন্য এবং উজানের দেশ ভারত হবার কারণে, বাংলাদেশ তার নিজস্ব পানি পরিকল্পনা সফলভাবে করতে পারবে না। কেননা বৈরী এবং আগ্রাসী ভারত যে কোন সময় ইচ্ছা করলেই ভাটির দেশ বাংলাদেশকে খরায় শুকিয়ে এবং বন্যায় ডুবিয়ে সর্বনাশ করতে পারবে। ছোট এবং দরিদ্র দেশ হবার কারণে বাংলাদেশের নাজুকতা আছে প্রায় সব বিষয়েই। কিন্তু তবুও নিজেদের বাঁচার তাগিদে জীবন-জীবিকা রক্ষা করার কারণেও সর্বনাশা মরুকরণ প্রক্রিয়া রোধ করার জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব শক্তিশালী পানি পরিকল্পনা থাকতেই হবে। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নদী-নালার পানি নিয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হতে পারে ব্রহ্মপুত্র মেঘনা এবং পদ্মা নদীর বেসিন এলাকার পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের বহুমুখী প্রকল্প তৈরী করা। প্রয়োজন হলে এই সব নদীর সংযোগের জন্য অভ্যন্তরীণ ছোট ছোট খাল খনন। শুকনা মওসুমে পানি ধরে রাখার জন্য জলধারা নির্মাণ। পদ্মাসহ সম্ভাব্য সব বড় নদীতে বাঁধ নির্মাণ করা। বিশেষ করে ফারাক্কার হাত থেকে দেশ রক্ষার প্রধান হাতিয়ার হলো শহীদ জিয়াউর রহমানের পরিকল্পিত পদ্মা নদীর উপর গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ। আর যেটা নির্মাণ করতে গিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান ভারতের “গোয়েন্দা সংস্থা’র” ষড়যন্ত্রে ১৯৮১ সালের ৩০মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শাহাদৎ বরণ করেন। গঙ্গা বাঁধ বাস্তবায়নের মধ্যে বাংলাদেশের পানি সম্পদ রক্ষার মুলমন্ত্র লুকিয়ে আছে।