ঐক্যের হিসাব মিলছে না খালেদার

0
1985

গড়াইনিউজ২৪:‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিনে জন্মদিন পালন করা যাবে না, জাতির পিতাকে গালাগাল করা যাবে না, জামায়াতকে ছাড়তে হবে’— চায়ের দাওয়াতে গিয়ে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যখন এমন শর্ত তুলে ধরেন, তখন চুপচাপ ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। পাশে বসা সিনিয়র নেতারাও ছিলেন নিশ্চুপ। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির এক নেতার ভাষায়, ‘জাতীয় ঐক্যের শুরুতেই যখন শর্তযুক্ত প্রস্তাব আসে, তখনই এ প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ কি ঐক্য করতে এসেছে না বিএনপির কাছে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরতে এসেছে— তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।’

ঐক্য প্রক্রিয়ার সফলতা নিয়ে সন্দিহান খোদ বিএনপির হাইকমান্ড। জঙ্গিবাদবিরোধী প্লাটফরমের ভবিষ্যৎ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু করছেন। শীর্ষ নেতৃত্ব আশঙ্কা করছেন, যাদের চায়ের আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, তারা সরকারের টার্গেটে পড়তে পারেন। বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ায় ওইসব দলকে যুক্ত হতে না দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকিও আসতে পারে। নতুন করে মামলা-হামলার সম্মুখীন হতে পারেন আমন্ত্রিত দলের শীর্ষ নেতারা। এ ক্ষেত্রে তারা পিছুটান দিতে পারেন। এজন্যই চায়ের আমন্ত্রণে এসেই নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সবকিছু বিবেচনায় বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ নাও দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে ২০-দলীয় জোটই বিএনপির শেষ ভরসা বলে মনে করা হচ্ছে। জানা যায়, সিপিবি ও বাসদ এরই মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়াকে ‘না’ জানিয়ে দিয়েছে। অবশ্য তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গেও ঐক্য না করার কথা বলেছে। ওই দল দুটি পৃথকভাবে এক মাসের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন ও বিকল্পধারা বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে সেই অর্থে যোগাযোগ করতে পারেনি বিএনপি। তারাও বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘সন্দিহান’ বলে জানা গেছে। অবশ্য এরই মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব দুই জোটের বাইরে পৃথক ঐক্য গড়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। এ প্রক্রিয়ায় বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন, ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী সম্পৃক্ত হতে পারেন বলেও জানা গেছে।

বিএনপির একাধিক নেতা জানান, কাদের সিদ্দিকী যখন বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঐক্য করতে যাননি, তখন বোঝার আর কিছু বাকি থাকে না। আর বৈঠক করতে গিয়ে শুরুতেই যখন শর্ত জুড়ে দেন, তখন তার বৈঠকে যাওয়ার উদ্দেশ্যও বুঝতে বাকি থাকে না। এর আগেও কাদের সিদ্দিকী চেয়ারপারসনের সঙ্গে বৈঠক করে নিচে এসে তাত্ক্ষণিক কঠিন শর্ত জুড়ে দেন। বিএনপি কাদের সিদ্দিকীর শর্ত পূরণের রাজনীতি করে না, এ মুহূর্তে দেশ ও জনগণের স্বার্থ নিয়ে ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাদের সিদ্দিকীই নন, বিএনপি জোটের বাইরে থাকা অন্য দলগুলোকে নিয়েও ঐক্য গড়া কঠিন হবে। সরকারি চাপেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, তারা বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে না। বিএনপির ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘প্রত্যেক দল তাদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরতেই পারে। এগুলো কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। এটা প্রাক-আলোচনা মাত্র। আমরা মনে করি, চলমান সংকট একটি জাতীয় সমস্যা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিএনপি দলীয় স্বার্থ বিবেচনা করছে না। জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। সরকারকেও ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের চেয়ারপারসন। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। তাই অন্যসব দলকে সঙ্গে নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আলোচনার চেষ্টা করছি। প্রত্যেকেরই মত-পথ আলাদা। কিন্তু আমরা চাচ্ছি, দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐক্য করতে। আশা করছি, আমরা সফল হব।’ এদিকে জেএসডি সূত্রে জানা যায়, তাদেরও চায়ের আমন্ত্রণ জানানো হয়। দলটি আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য ইতিবাচকও ছিল। কিন্তু সম্প্রতি জামায়াতকে নিয়ে অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদের মন্তব্যের পর বিএনপি থেকে যখন বলা হয়, এটা তার ব্যক্তিগত মত, তখন জেএসডি দলীয়ভাবে বৈঠক করে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। খালেদা জিয়ার চায়ের আমন্ত্রণে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিষয়টি বিএনপিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সূত্রমতে, আ স ম আবদুর রবের পক্ষ থেকে পৃথক প্লাটফরমে বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বামসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জামায়াত বাদে অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক ইসলামী দলকেও যুক্ত করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জেএসডির এক নেতা জানান, প্রগতিশীল দল ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের এ প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘আমরা গণতান্ত্রিক দল ও পেশাজীবী শ্রেণিকে নিয়ে পৃথক প্লাটফরম করার চিন্তাভাবনা করছি। কারণ, আমরা বুঝতে পারছি, জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি লুকোচুরি খেলছে। এটা আমাদের কাছে ভালো মনে হয়নি। তাই দলীয়ভাবেই আমরা দুই জোটের বাইরে আলাদাভাবে ঐক্য গড়ার কাজ শুরু করেছি।’ গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ‘দেশে একটি দুর্যোগ চলছে। এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই। জঙ্গিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়তে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসছেন। আমাদের সভাপতি দেশের বাইরে। দু-তিন দিনের মধ্যে ফিরবেন। চায়ের আমন্ত্রণ পেলে আমরা চিন্তাভাবনা করব। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে যে আলোচনাই করি না কেন, তার ভিত্তি হতে হবে ’৭২-এর সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা, গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থাকতে হবে।’ সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য হায়দার আকবর খান রনো জানান, ‘আমাদের কাছে প্রধান দুই দলই আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। কিন্তু দুই দলকেই আমরা না করে দিয়েছি। কারণ, আমাদের মনে হয়েছে, তারা যতটা না জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। চায়ের আমন্ত্রণে গিয়ে কাউকে আমরা রাজনৈতিক ফায়দা লোটার সুযোগ দিতে চাই না। আমরা চাই, দেশের ১৬ কোটি মানুষের ঐক্য, বিএনপি-আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে গিয়ে নয়।’ বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান জানান, ‘সিপিবিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এক মাসের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। তার দিকেই আমাদের এখন মনোযোগ। তা ছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকেও কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পাইনি। তবে আমরা আগেই বলেছি, বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা, প্রশাসনে দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রেখে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যাবে না। এজন্য আমাদের আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যখন জঙ্গির পিতা-মাতার অন্তরে রক্তক্ষরণ হওয়ার পরও লাশ নিতে পর্যন্ত আসেন না তখন বুঝতে হবে, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য আছেই। তবে এ নিয়ে দুই দলের ফায়দা লোটার রাজনীতি কাম্য নয়।’