বিধি মেনে কারখানা খুলতে চান ব্যবসায়ীরা

0
1831

গড়াইনিউজ২৪.কম:: প্রাণঘাতী করোনার প্রকোপ মোকাবিলায় দেশে চলছে লাগাতার সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের মতো পরিস্থিতি। ফলে অভাব কড়া নাড়ছে দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্তের দরজায়। দীর্ঘ সময় এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী পথে বসবে। চাকরি হারাবে লাখ লাখ মানুষ। দেশের অর্থনীতিতে নামবে ধস। ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, বিভিন্ন রফতানি পণ্যের ক্রয়াদেশ চলে যেতে পারে প্রতিযোগী দেশগুলোতে। কারণ এরই মধ্যে ইউরোপের সবচেয়ে আক্রান্ত দেশ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানি লকডাউন সীমিত পরিসরে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে ও অস্ট্রিয়া লকডাউন তুলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য লকডাউন পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল করার কথা বলছেন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। যাদের রপ্তানি আদেশ আছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের কারখানা সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার আভাসও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, করোনার প্রকোপ কমায় চীন সব ধরনের কার্যক্রমে ফিরেছে। তাইওয়ান, হংকং, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানও স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিয়ন্ত্রণ উপযোগী এলাকার শিল্প-কারখানা বা অফিশিয়াল কার্যক্রম সীমিত পরিসরে খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের সবকিছু বন্ধ থাকলে রপ্তানি আদেশ অন্যত্র চলে যাবে। আর এতে করে ব্যক্তি খাত বসে যাবে, বিপুল জনগোষ্ঠী কর্মহীন হবে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়াসহ সরকারের রাজস্ব আয় কমে ব্যয় বাড়বে। এজন্য সবাইকে সচেতন করা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলার মধ্যে সীমিত পরিসরে কিছু কিছু শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ধীরে ধীরে খুলে দিতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এ কাজে সহায়তায় লাগাতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রি খাতের উৎপাদিত পণ্য ও জিনিসপত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ে একসঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় রাজধানী ঢাকায় আনা বা যেখানে বড় বড় বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে হবে। সস্প্রতি ঢাকা বিভাগের কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানা মালিকদের বলেন, ‘পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে রোজার মাসের মধ্যে সীমিত আকারে কিছু গার্মেন্টস ও শিল্প কারখানা চালু করা যেতে পারে। সামনে রোজা, আমরা সবাইকে একেবারে বন্ধ করে রাখতে পারব না। আমাদের কিছু কিছু জায়গা আস্তে আস্তে উন্মুক্ত করতেই হবে।’ বিজিএমইএর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফয়সাল সামাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘কারখানা খোলার ব্যাপারে বিজিএমইয়ের অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে কারখানা চালু করার আগে শ্রমিক ভাই-বোনদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সবাই জানি, আরএমজি সেক্টর আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কারখানার চাকা থেমে গেলেও শ্রমিক-মালিক একসঙ্গে জীবন বাঁচাতে জীবিকা রক্ষায় থাকতে হবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে।’ তিনি বলেন, ‘পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও লকডাউন হালকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদেরও এদিকে চিন্তা করা উচিত। এজন্য আমরা সদস্যদের একটা সার্ভে পাঠাতে বলেছি। সেখানে কার কী প্রয়োজন বা কী করা দরকার, কোন কারখানা কোন পর্যায়ে আছে সে বিষয়গুলো জানতে আমাদের তিন চারদিন লাগবে। এরমধ্যে আমরা আইএলও, স্বাস্থ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গাইডলাইন তৈরি করছি। যার মাধ্যমে আমরা শ্রমিকদের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি। কারখানাগুলো খুলতে হলে সবকিছু চিন্তাভাবনা করতে হবে। এজন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বাংলানিউজকে বলেন, ‘করোনায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে সেটা নিশ্চিত। এজন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অন্যান্য দেশ যেভাবে এগোচ্ছে সে আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যদি কাজে ফিরে আসতে চাই, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা থাকতে হবে। এজন্য পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের এগেয়ে যেতে হবে। যাতে করে দেশের ব্যবসা ও অর্থনীতি সচল থাকে।’ বাংলাদেশে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি এবং বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদি বাংলানিউজকে বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে লকডাউনের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। এতে আমাদের অনেক অর্ডার বাতিল হয়েছে, যাও আছে তা বাতিল হওয়ার পথে। এতে অনেক কারখানা বন্ধ হবে, অনেক শ্রমিক কাজ হারাবে। আমরা দিন দিন আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছি। যদিও সরকার আমাদের কিছু প্রণোদনা দিয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি বিচারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে কারখানা খোলা রাখা উচিত।’ ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক আবদুস সোবহান বলেন, ‘রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিশেষায়িত অঞ্চল বলে পরিচিত দেশের ইপিজেডগুলোও এখন বলা যায় বন্ধ। ঢাকা ইপিজেডে একটি কারখানা ইউরোপ-আমেরিকায় মাস্ক, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের পোশাক বানানোর বিশেষ কাজের জন্য সীমিত পরিসরে চালু আছে।’ তিনি জানান, ইপিজেডে এমনিতেই নিরাপত্তা ও নিরাপদ স্বাস্থ্যের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন উদ্যোক্তারা। তাই যাদের রফতানি আদেশ আছে, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে কাজ চালু করতে পারেন। তবে সবই সরকারের শীর্ষ মহলের সিদ্ধান্তের বিষয়। এখন যদি কারখানা দীর্ঘ সময়ের জন্য পুরোপুরি বন্ধ থাকে, তবে অর্ডার ফিরে যেতে পারে। যেহেতু ভিয়েতনাম ভালো অবস্থায় আছে, সেখানে পুরোদমে কাজ হচ্ছে, অর্ডার সব চলে যেতে পারে ওখানে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনার প্রভাব দেরিতে হয়েছে। তাই আমাদের শেষটাও দেরিতে হবে। সে হিসেবে আমাদের লকডাউনটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এই লকডাউন যতো দীর্ঘস্থায়ী হবে ততো বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে। অবস্থার উন্নতি হলে সবকিছু কীভাবে খোলা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে আমরা কবে সে অবস্থায় যাব তা বলা যাচ্ছে না।’ সিপিডির সিনিয়র গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলানিউজকে বলেন, ‘স্বাস্থ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা থাকলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি গভীরতর হবে। আগের অবস্থানে ফিরতেও অনেক সময় লাগবে। সুতরাং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অত্যাবশ্যকীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে হবে।’ জানা গেছে, ২৪ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয় ‘প্রয়োজনে ওষুধ শিল্প ও রফতানিমুখী শিল্প কারখানা চালু রাখতে পারবে।’ পরবর্তী সময়ে এ সংক্রান্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা সব সার্কুলারেও রফতানিমুখী শিল্প কারখানাগুলোকে সাধারণ ছুটির আওতামুক্ত রাখার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া গত ১ এপ্রিল কল-কারখানা অধিদফতর ‘শিল্প কারখানা চালু করা প্রসঙ্গে একটি নির্দেশনা জারি করে। যেখানে উল্লেখ আছে, এ অবস্থায় যেসব রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ রয়েছে ও শিল্প কল-কারখানা সচল রাখতে আগ্রহী এবং করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জরুরি অপরিহার্য পণ্য যেমন- পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার, ওষুধপত্র ইত্যাদি উৎপাদনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে, সেসব কল-কারখানা মালিকরা শ্রমিকদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করে শিল্প কল-কারখানা চালু রাখতে পারবেন। এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবার নিকট স্পষ্টীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো’। ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেন। পরে তা ১২ এপ্রিল ও ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সবেশেষে আড়গামী ৫ মে পর্যন্ত ছুটি বাড়ানো হয়েছে। প্রায় একইসঙ্গে পোশাক কারখানাও ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখার অনুরোধ জানায় বিজিএমইএ। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণে লকডাউনের মধ্যেই হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকায় ফেরেন। এতে কারখানার মালিকরা সমালোচনার মুখে পড়েন। এদিকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় পুরো বাংলাদেশ করোনা ভাইরাস মহামারির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ঘোষণা করেছে সরকার। প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হলো ১৩১ জনের। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ৫০৩ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৬৮৯ জনে।