নজরুল ইসলাম তোফা, গড়াইনিউজ২৪.কম:: পৃথিবীতে যুগে যুগে কিছু মানুষের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের অধিকাংশই কোটি কোটি টাকায় ভোগ-বিলাস, ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি নিয়ে জীবন স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু এমন কিছু বিকল্প চিন্তা চেতনার মানুষকে খোঁজে পাওয়া যায়, জীবনে কোন কিছুর মোহ নেই, নেই নূন্যতম মনের ইচ্ছা পূরণের উচ্চাকাঙ্খা। জীবনকে সঠিক পথে পরিচালনার উদ্দেশ্য অতীব ক্ষিন। অর্থের লোভ না থাকলেও প্রয়োজন আছে পেটে ভাতে বেঁচে থাকার অধিকার। কিন্তু উপার্জনের আদৌ কোনোই পরিকল্পনা নেই, এমন একজন প্রতিভাবান, সরল, কোমল মনের ছোট্ট মানুষ, শুধুই দেখে রঙিন স্বপ্ন, চরম আশা আশঙ্কা মিউজিক নিয়ে। মিউজিক জগতে বহুগুনের অধিকারী ছেলেটি সবাইকে অবাক করে দেওয়ার মতোই প্রতিভা। মিউজিকের নেশাটা নিত্য দিনের জীবন সঙ্গী। নাম তার মো: আব্দুল বারী।
নওগাঁ জেলার মান্দা থানায় তেরো নম্বর কশর ইউনিয়নের পাঁজর ভাঙা গ্রামে নিজ পিতা-মাতা, সহধর্মিণী সহ এক পুত্র সন্তান নিয়ে তার বসবাস। গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছে গান ও মিউজিক বাজানোটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ছেলে মেয়েরা তার কাছে মিউজিকের সঙ্গে কিভাবে গান করতে হয় তা শিখে নিয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় তথা গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে থাকে। মিউজিক প্রেমী আব্দুল বারী তাদের সহযোগী হয়েই সকল অনুষ্ঠানে মিউজিক বাজায়। অনেক মিউজিক বাজাতে পারে। যেমন: হারমোনিয়াম, ড্রামস, কঙ্গো, জুড়ি, ফুলোট এবং আঁড় বাঁশি। তার মধ্যে ড্রামস মিউজিকই উপস্থিত দর্শকদের মাঝে বাজিয়ে বেশ আনন্দ পায়। তার প্রিয় মিউজিক সহ অন্যান্য মিউজিক নিয়ে নওগাঁ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বায়না যায়। তরুণ প্রজন্মের প্রতিভাবান তারুণ্যের প্রতিক, স্বল্প ভাষী, মিউজিক ম্যান আব্দুল বারী অল্প বয়সেই জয় করেছে অসংখ্য শ্রোতা ও দর্শকের হৃদয়। এখন তার বয়স প্রায় সাতাশ আটাশ হয়তো হবে। ছাত্র জীবনের শুরুতেই তার জীবনে নেমে আসে অমানিশার ঘোর আঁধার, পড়াশোনা হয়নি তার। সঙ্গীত, নৃত্য, বিভিন্ন মিউজিকের সাথে সখ্যতায় ছোটবেলা কাটে। নিজস্ব স্টাইল বজায় রেখে মিউজিক বাদ্যে আত্মবিশ্বাসের সাথেই কাজ করে। জেনে নিই এমন ছেলেটির করুন কাহিনীর আদ্যোপান্ত। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই তার বেড়ে ওঠা নয়। বাবার নাম মো: কমর উদ্দিন শাহানা তিনি একজন গুণী মৌলবী। মা মোছা: মনোয়ার বেগম একজন পর্দাশীল গৃহিণী মহিলা। বাবা মিউজিক অনুরাগী না হলেও বংশে তার দাদা ছিল কবি গানের সরদার অর্থাৎ ছন্দের গায়ক। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মো: আব্দুল বারীকে তার বাবা ধরে বেঁধে জোরপূর্বক লেখাপড়া শেখাতে পেরেছে। পরিবারের কেউ ভাবেনি সে প্রফেশনালি ড্রামস বাদক হয়ে লেখাপড়ার পাঠ চুকে দিবে। ইচ্ছে ছিল ছেলে বড় হয়ে সমাজের আর দশটা ছেলেদের মতো চাকরি করবে। কিন্তু বাল্য বয়সে মস্তিষ্কের কোষে কোষে গেঁথে গেল যাত্রা দলের গান, যাত্রার নৃত্য এবং যাত্রার মিউজিক। সব কিছু ছাপিয়ে যাত্রার যে ড্রামস মিউজিক তা নিয়ে মাতিয়ে তোলে মন্ত্রমুগ্ধ বাদ্যের ঢংঙে।
তরুণ বয়সে নিজ গ্রামের স্কুলে প্রতি বছর যাত্রা নাটকে নারী চরিত্রের পাঠ গাওয়া ও নাচনেওয়ালী মেয়ে নিয়ে আসতো। আব্দুল বারী শৈশব থেকেই তাদের সঙ্গে একই ভঙ্গিতে নাচনেওয়ালী সঙ্গে নাচতো এবং দর্শক নারী-পুরুষের নৃত্যে বেশ মজা নিতো। গায়ক হিসেবে তার পরিচয় যতটা না ছিল তারচেয়ে নাচ ও মিউজিক বাজানোর পরিচিতি অনেক উর্ধে ছিল। মিউজিক বাজানো অভিজ্ঞতা তার দেখে দেখে শেখা। তেমন কোন উস্তাদ গুরু ছিলো না, বলতে গেলে নিজস্ব প্রতিভা তার। তবে বাড়ির পাশে একজন দক্ষ প্রবীণ ব্যক্তি উত্তর খুব সুন্দর হারমোনিয়াম ও অর্গান বাজাতো। তার সঙ্গে আব্দুল বারীর উঠা বসা হতো। উত্তম নামের ব্যক্তি এমন প্রতিভা দেখে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেত। বলা যায় অল্প বয়সে কচি মেধার ছেলেটিকে এমন ভাবে সঙ্গে না নিয়ে ঘুরলে হয়তো জীবনে শিক্ষা-দিক্ষার দ্বার প্রান্তে পৌঁছাতে পারতো। আব্দুল বারী কাঁচা বুদ্ধিতে উত্তমের সঙ্গী সাথী হয়ে দূরদূরান্তের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচতো এবং বিভিন্ন মিউজিক বাজিয়ে দর্শকদের আনন্দ দিত। আর এসব কারণেই শ্রী উত্তম কুমার প্রয়োজনের তাগিদে মো: আব্দুল বারীকে ব্যবহার করতো। ব্যতিক্রম চিন্তা ধারার ছোট্ট ছেলেটি উত্তমের ডাকে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বিয়ে-বাদি, কিচ্ছা-কাহিনী, যাত্রা-পাটি এবং স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে নৃত্য করা ও মিউজিক বাজানোর কাজে দূরদূরান্তে চলে যেতো। তার বাবা মার হাজারো বাধা উপেক্ষা করে। লেখাপড়ায় ক্ষতি হতে লাগল মুটেও টের পাওয়া মানসিকতা তার ছিলোনা। স্কুল শিক্ষক তার বাবাকে জানালেন আপনার ছেলে স্কুলে আসেনা। স্কুল কর্তৃপক্ষ এমন অনিয়মিত ছাত্র আর চায়না। বাবা নিরুপায় এখন ছেলেকে নিয়ে কি করবে? পরে চিন্তা করে স্থির করলেন চার ছেলে ও দুই মেয়ে মধ্যে একটি ছেলে হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হলে মন্দা হয়না। যথারীতি সেখানে আব্দুল বারীকে ভর্তি করিয়েও মিউজিক বাজানোর পোকা থেকে সরাতে পারেননি। মনে ভর করে থাকা ড্রামস মিউজিক, বানিয়ে ফেলতো ওজুর বদনা, পানির কলস এবং খাবার প্লেট-বাটি। ছাত্রদের কাছে বাজিয়ে আনন্দ করতো এবং নাচতো। প্রতিদিনের এমন আচরণে তার উস্তাদ চরম বেত্রাঘাত করলে সেখান থেকে বাড়ি পালিয়ে আসে। দু’তিন বার পাঠিয়েও তাকে মন স্থির করাতে পারেনি। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যেই তিন পারা কোরআন শরীফ মুখস্থ করেছে। এত সুন্দর শুদ্ধ উচ্চারণ, শ্রুতি মধুর গলা শুনলে সত্যিই অবাক হবেন। প্রতিভাবান এই ছেলে লেখাপড়ায় অনুগত নাহলে আবারও চরম মারধর করে। জেদী ছেলে আব্দুল বারী পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে এবং ছয় মাস নাটরের এক যাত্রা ক্লাবে উঠে। অল্প সময়ের মধ্যে যাত্রা দলের মেয়েদে নৃত্য গুরু হয়ে উঠে। সেখানেই থাকতে থাকতে যাত্রার সব মিউজিক যন্ত্র বাজনো পুঙ্খানুপুংখ শিখে ফেলে। বিশেষ করে যাত্রার মিউজিকের মধ্যে ড্রামস বাজানোর পারদর্শীকতায় অতুলনীয় ছিল। যেখানেই যাত্রাদল ভাড়া যেতো সেখানেই মেয়েদের সঙ্গে চলে যেতো। কারণ তাদের গুরু ড্রামস না বাজালে মেয়েরা নাকি নাচতে পারতো না। এমন প্রতিভাবান ছেলের সন্ধান অনেক খোঁজাখুঁজি পর মিলে।। বাড়িতে জোর করে ধরে এনেও এ জগৎ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি তার বাবা। কি করবে ছেলেকে? পড়াশুনায় সে নারাজ, স্থির করলেন বিয়ে দিলেই ঠিক হবে হয়তো। যথারীতি বিয়ে হয় কিন্তু সংসার টিকে না। দীর্ঘ সময় একাগ্রতায় কোন দন্দ-ফাসাৎ না করেই সে চলে। এদিকে তার বাবা-মা জানতে পারে কলেজ পড়ুয়া মেয়ে রাজিয়া তাকে ভালোবাসে। প্রেমের বিয়েতে এক পুত্র সন্তানের বাবা আব্দুল বারী। স্ত্রীর রাজিয়া বিএ পাশ করে আশা ব্যাংকের ক্যারিয়ার পদে চাকরি করে সংসার চালায়। কিন্তু মিউজিক নিয়ে যে পরিকল্পনা, মনের ইচ্ছা অপূর্ণই থাকে নিজ ইনকাম নেই বলে। তার চাওয়া একটা মিকচার মেশিন অর্থাৎ সে যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সব ধরনের মিউজিক মিশ্রণ করে শ্রুতিমধুর বাদ্যে শ্রোতা, দর্শনের মন জয় করবে। তাছাড়া কোন সুহৃদ ব্যক্তির সান্নিধ্য পেলে তার ড্রামস মিউজিক বাদ্যটি কাজে লাগাতে আশা পোষণ করে।